বসিরহাটের দক্ষিণে এক শান্তিপ্রিয় গ্রাম — মদনপুর। এই গ্রামের বটতলার চায়ের দোকানই হলো গ্রামের হেডকোয়ার্টার। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলে চা, ক্রিকেট, রাজনীতি এবং পাড়ার লোকজনদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই গ্রামের এক যুবক রাজু মন্ডল। সে নিজেকে অনেক বড় কিছু ভাবত — পেশায় পুলিশ কনস্টেবল। পুলিশি উর্দির জোরে সে ধীরে ধীরে গ্রামের মাথা হয়ে উঠেছিল।
রাজুর বাবা পেশায় রিকশাচালক। মা হাঁস-মুরগি সামলায় আর মাসে তিন দিন “অ্যাসিডিটি”র ওষুধ খায়। কিছু বছর আগে অবধি রাজুকে কেউ চিনতো না, কেউ পাত্তাও দিত না। কিন্তু যবে থেকে সে পুলিশে চাকরি পেয়েছে, তারপর থেকে সে গ্রামের একজন কেউকেটা ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। বড়রা সমীহ করে, ছোটরা তাকে হিরো ভাবে, আর মেয়েরা সবাই একেবারে রাজুর উপর ফিদা। রাজুই মদনপুরের শাহরুখ, রাজুই মদনপুরের হৃত্বিক। এক কথায় রাজু ছিল গ্রামের চোখের মণি, কারণ সে ছিল পুলিশের চাকরিতে।
রাজুর বয়স ছাব্বিশ। দেখতে সুন্দর, মুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। গায়ে সবসময় চাপানো টাইট ফিটিং খাকি পোশাক, মাথায় টুপি, চোখে চশমা আর বুকে ঝকঝকে নেমপ্লেট । যেইভাবে সে হাঁটে, গায়ের জোরে কথা বলে, সবাই চোখ ছানাবড়া করে দেখে আর অবাক হয়।
গ্রামের লোকজন তাকে একরকম পুজো করত। সবাই মনে মনে রাজুকে খুশি রাখতে চায়। বলা যায় না, পান থেকে চুন খসলেই যদি রাজু কেস দিয়ে দেয়। চায়ের দোকানদার লক্ষ্মীকান্ত তো সোজা বলে দিয়েছিল, “আমাদের রাজু স্যার চা খেতে এলেই আমি টাকা নেব না।”
রিকশাওয়ালা সন্তু, টোটোওয়ালা শিবা এবং আরও অনেক ভ্যান-অটোওয়ালারাও রাজুকে দেখলেই বলে, “স্যার, উঠুন… কোথায় যাবেন?”
সিনেমা হোক বা ট্রেনের টিকিট কাউন্টার – রাজুকে লাইনে দাঁড়ানোর দরকার পড়ত না। মাথায় টুপি চাপিয়ে রাজু শুধু বলত, “ডিউটি আছে,” ব্যাস লাইন ফাঁকা।
সেই রাজু যখন বটতলার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বীরত্বের গল্প শোনাত, তখন বাচ্চারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসে বসত, বড়রা চা ঠান্ডা করে বসে থাকত, আর দোকানদার পর্যন্ত বিক্রি বন্ধ করে হাঁ করে শুনত।
রাজু একদিন গল্প করল, “সে একদিন কী হয়েছে জানো? একটা লরি জিনিসপত্র পাচার করছে, আমি বাইকে চেপে পিছনে ধাওয়া করলাম। কী স্পিড জানো! বাইকের স্পিডোমিটার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি লরি থামাতে পেরেছিলাম। চোরকে ধরেই বললাম — রাজু দারোগাকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল”
আরেকদিন চায়ের আড্ডায় রাজু বলল, “একবার চার তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে একটা পকেটমারক ধরেছি। হাঁটুতে একটু আঘাত লেগেছিল, এখনো মাঝে মাঝে ব্যথা দেয়। তবে দেশের সেবা করতে গেলে কষ্ট একটু সহ্য করতেই হয়!”
আরেকদিন রাজুর গল্প —“এক বন্দুকধারী আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। আমি পাশের খেঁজুর গাছের আড়ালে লাফ দিয়ে গুলি এড়িয়ে গেলাম। তারপর একা একাই তাকে ধরলাম। থানার বড়বাবু পর্যন্ত আমাকে বাহবা দিয়েছেন!”
এইসব গল্প শুনে গ্রামের লোকজনের চোখে রাজু দিন দিন মহান হয়ে উঠছিল। গ্রামের মেলায় স্পাইডার ম্যান, সুপার ম্যান, শাহরুখ, হৃত্বিকের ছবির বিক্রি কমে গেল, সেসবের বদলে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা তাদের ঘরের দেওয়াল রাজুর বড় বড় কাটআউট লাগাতো। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা মিলে রাজুর নামে ফেসবুকে ফ্যান-পেজ বানালো। রাজুর নানারকম পোজের ছবি আর ভিডিও সেখানে আপলোড হতেই রাতারাতি পেজের ফলোয়ার লাখ ছাড়িয়ে গেল। ভাইরাল হয়ে গেল এই ছোট্ট গ্রামের রাজু দারোগা।
গ্রামের অন্য বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের রাজুর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলত, “দ্যাখ, চেষ্টা করলে তবেই সাফল্য আসে।“ রাজুর বাবা-মাও নিজের ছেলের সাফল্যে খুব খুশি ছিল। মা তো রোজ তুলসী গাছে জল দিয়ে বলত, “ঠাকুর, ছেলেকে প্রোমোশন দাও, কনস্টেবল থেকে হেড কনস্টেবল বানাও।”
সব ঠিকঠাকই চলছিল, হঠাৎ একদিন গ্রামের মন্দির থেকে ঠাকুরের সোনার হার উধাও হয়ে গেল। মন্দিরের পুরোহিত গলদগর্ম হয়ে চেঁচাতে লাগল, “হার গেল! ঠাকুরের সোনার হার চুরি গেছে!”
গ্রামবাসীরা উত্তাল! কেউ বলছে বহিরাগত চোর, কেউ বলছে পাড়ার চন্দন ছেলেটা রাতেই ঘোরাঘুরি করছিল। মনে হচ্ছে ঐ চুরি করেছে।
থানায় খবর গেল। একেবারে খোদ থানার বড়বাবু দেবাশীষ দত্ত নিজে এলেন তদন্ত করতে। লোকজন তাঁকে ঘিরে বলল, “বাবু, আপনি এত কষ্ট করবেন না। আমাদের গ্রামে রাজু দারোগা আছেন, উনিই সব ঠিক করে দেবেন। আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি গিয়ে ঘুমান।”
এই কথা শুনে দেবাশীষ দত্ত খুব অপমানিত হলেন। সাথে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, “রাজু কে?”
“আরে বাবু! আমাদের গ্রামের গর্ব! সল্টলেকে পোস্টিং! বড় পুলিশ অফিসার! আপনার থানার কনস্টেবল।”
দেবাশীষ দত্ত একরকম হতবাক। এই নামে কেউ তার থানায় নেই তো! তখনই বললেন, “তাকে এখনই ডাকো!”
কিন্তু রাজু তখন বুঝে গেছে, তার খেলা শেষ হয়ে আসছে। ঝোলা থেকে সাপ বেরিয়ে পড়লো বলে। সে তাড়াতাড়ি বাড়ির পেছনের বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। সবাই দরজা ধাক্কাচ্ছে আর রাজু ভেতর থেকে বলছে, “আমার পেট খারাপ হইছে, দেরী হবে, স্যারকে বলো থানায় গিয়ে দেখা করব।”
কিন্তু দেবাশীষ দত্ত তখন এমন এক মেজাজে ছিলেন, যেটাকে বাংলায় বলে “নাছোড়বান্দা”। তিনি বুক ফুলিয়ে বললেন, “আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। পেট খারাপ থাক বা মাথা ঘোরা, ওকে তো একদিন না একদিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেি হবে!”
অগত্যা রাজুকে বাইরে আসতেই হলো।
হাতের গামছা দিয়ে পেটটা আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা, খালি গা, চুলগুলো এলোমেলো, আর মুখে এমন একটা ভঙ্গি যেন সে নিজেই একটা চোর। তাকে দেখে দেবাশীষ দত্ত চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এরে বাবা! এ কে! এ তো কোনো কনস্টেবল না, এটা তো ‘কন-স্টেবল’— মানে ধোঁকাবাজ কনস্টেবল!”
চারদিক তখন টানটান উত্তেজনা। রাজুর বাপ, গ্রামের মোড়ল, চায়ের দোকানদার থেকে শুরু করে লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালা — সবাই এল খবর শুনে।
শুরু হল রাজুর ঘরে তল্লাশি। এবং একে একে বেরিয়ে এল ইতিহাস খননের মতো কিছু আশ্চর্য জিনিস—
- তিন সেট ঝকঝকে খাকি পোশাক (একটার পকেটে ছিল ‘হিরো’ লেখা হেয়ার জেল)
- দুটো প্লাস্টিকের পিস্তল, যেগুলো ‘টিপলে লাইট জ্বলে আর বাঁশি বাজে’
- একখানা ভুয়ো আইডি কার্ড, যেখানে বড় বড় করে লেখা— “রাজু মণ্ডল, পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সিক্রেট অফিসার”
- কয়েকটা ফেসবুক ছবির প্রিন্টআউট— রাজু খাকি পরে লুঙ্গি পরা লোককে ‘জেরা’ করছে, একজনের গালে চড়ের অভিনয় করছে, ক্যাপশনে লেখা “ক্রিমিনাল ধরা হল!”
সব দেখে দেবাশীষ দত্ত মাথা চুলকে বললেন, “এ তো পুরো সিনেমার চিত্রনাট্য!”
রাজু এবার এক লাফে গিয়ে দেবাশীষ বাবুর পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলল, “স্যার, ভুল হয়ে গেছে। ভীষণ ভুল। একটু নাটক করেছিলাম মাত্র।”
দেবাশীষ বললেন, “তুই নাট্যশিল্পী না পুলিশ? কীসের ভুল?”
রাজু তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “স্যার, একবার যাত্রাপালায় আমি পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। শো শেষ হয়ে গেল, কিন্তু ট্রেন ধরার তাড়া ছিল। তাই পুলিশের পোশাক পরেই বাড়ি ফিরি। হাওড়া স্টেশনে দেখলাম, লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না। লোকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। রিকশাওয়ালা ‘স্যালুট’ করে বিনা পয়সায় পৌঁছে দিল বাড়ি। তখন মাথায় এল—আরে! এ তো খাকি নয়, যেন যাদু পোশাক! এরপর একটু একটু করে… আমি অভিনয়টা চালিয়েই গেলাম। যত লোকে মান্যিগন্যি করা শুরু করল, আমার নেশাও তত বাড়তে লাগলো।”
দেবাশীষ দত্ত একটু থেমে বললেন, “তুই জানিস, তোর কাণ্ডে ফৌজদারি মামলা হতে পারে?”
রাজু তখন গলায় কান্না এনে বলল, “স্যার, কাউকে ঠকাইনি তো। শুধু… সম্মান কুড়িয়েছি। আর ফেসবুকে কিছু লাইক পেয়েছি।”
চায়ের দোকানদার চেঁচিয়ে বলল, “আর আমার দোকান থেকে একবছর চা ফ্রিতে চা-বিস্কুট-ডিম-পাউরুটি খেয়েছিস!”
রিকশাওয়ালা বলল, “আমি বিনা পয়সায় রোজ ওকে স্টেশন অবধি নিয়ে যেতাম আর নিয়ে আসতাম।
এরকম আরও অনেকের থেকে অনেক সুবিধাই নিয়েছে নকল রাজু দারোগা।
দেবাশীষ দত্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। তোকে জেলে দেব না। তবে শাস্তি হবেই হবে। গ্রামের যাদের থেকে তুই সুবিধে নিয়েছিস, সবার কাছে ক্ষমা চাইবি। আর পঞ্চায়েতের সামনে ৫০০ বার কান ধরে উঠাবসা করবি।”
ভীড় থেকে একটা যুবতী মেয়ে সীমা এসে বললো, “আমি ওকে পুলিশ ভেবে আর ওর বাহাদুরীর গল্প শুনে ওকে ভালোবেসেছিলাম, সন্ধ্যবেলায় গাছের আড়ালে একবার চুমু খেয়েছিলাম। সেই চুমু কিভাবে ফেরত পাবো ?? আমার সেই চুমুও ফেরত চাই।”
দেবাশীষ দত্ত বললো, “মা, চুমু কিভাবে ফেরত দিতে হয় সেটা তো আমার জানা নেই। তবে রাজুকে আমি হুকুম দিলাম ও আগামী একবছর প্রত্যেকদিন রিকশা চালিয়ে তোমাকে বাড়ি থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। তাও আবার বিনা পয়সায়।“
পরদিন সারা গ্রামে মাইকিং হল — দেবাশীষ দত্ত নিজে মাইকে ঘোষণা করলেন,
📢 “শ্রদ্ধেয় গ্রামবাসীবৃন্দ, আজ বিকেল চারটায় স্কুল মাঠে নাট্যশিল্পী রাজু মণ্ডলের অভিনয়ের নাটকীয় পরিসমাপ্তি। আসুন, নিজের চোখে দেখুন!”
চারটার সময় মাঠে লোক উপচে পড়ল। কেউ ফ্রাই খাচ্ছে, কেউ মোবাইল ক্যামেরা চালু রেখেছে, কেউ আবার বাজি নিয়ে এসেছে।
রাজু যখন কান ধরে ওঠবোস করছে, হাপাচ্ছে, তখন গ্রামের লোকজন হাসছে। প্রচুর লোক লাইভ করছে।
ওঠবোস শেষ হতেই দেবাশীষ দত্ত একটা মাইকে হুঙ্কার দিয়ে বললেন—
“আজ থেকে পুলিশ, আসল হোক বা নকল, কারো কাছ থেকে ফ্রিতে চা খাবে না, রিকশায় বিনা পয়সায় চড়বে না। যদি কেউ সুবিধা নিতে চায়, সোজা আমার কাছে রিপোর্ট করো। আর যদি কেউ নাটক করে, তাহলে তাকেও রাজুর মতোই মঞ্চ পাবে!”
এরপর রাজু আবার রিকশা চালাতে শুরু করল। এবার তার গায়ে খাকি নেই, তবু পায়ে সেই পুরোনো কালো জুতো, অভিনয়ের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছে। লোকজন এখনও বলে, “পুলিশ না হতে পারে, তবে নাটক করাটা ভালোই জানে রাজু!”
তবে অনেকে অনেকে মনে মনে একথা স্বীকার করে, রাজু অভিনয় করে একদিকে ভালোই করেছে। রাজুর জন্যেই এখন আর কোনো পুলিশকে বিনা পয়সায় কিছু খাওয়াতে হয় না। এটাই মন্দের ভালো। রাজুর নামের ফেসবুক পেজটা এখনও আছে। রাজু এখন সেখানে রিকশা নিয়ে স্টান্টবাজি দেখায়। তার পেজ এখন আগের থেকেও বেশি ভাইরাল। প্রত্যেকদিন সীমাকে কলেজে নিয়ে যাওয়া আসা করতে করতে তাদের মধ্যে আবার ধীরে ধীরে মধুর সম্পর্ক গজিয়ে উঠছে, তবে সে গল্প অন্য দিন। আজ এটুকুই।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।