পর্ব ১ – এক সুন্দর আয়না
রিমার বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন হলো। জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা দিয়ে সে এখন এক অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনায় ভাসছে। তার স্বামী অরুপ একজন স্থপতি—শান্ত, রুচিশীল আর চমৎকার ব্যবহার তার। বিয়ের পর তারা উঠে এসেছে এক পুরোনো বাড়িতে, শহরের এক নিঃশব্দ কোণে। এই বাড়িটি ছিল রিমার দাদুর—একজন বিশিষ্ট আর্ট কালেক্টর, যিনি সারা জীবন নানা দেশ-বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন বহু দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্ম, প্রত্নবস্তু আর পুরাকীর্তি।
বাড়িটি যেন এক জীবন্ত সংগ্রহশালা—বড় বড় কাঠের জানালা, ছাদের কাছ থেকে ঝুলে থাকা ধুলোমাখা ঝাড়বাতি, দেয়ালে পুরনো ইউরোপিয়ান তেলের চিত্র, কাচে মোড়া জাপানি পুতুল, মিশরীয় মুখোশ, রোমান মুদ্রা, আর নানা জাতের আসবাবপত্র যেন এক রহস্যময় শীতল বাতাস বয়ে নিয়ে আসে এই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদে। একদিন বিকেলে, ঘর গোছাতে গোছাতে রিমা দাদুর কাঠের স্টোর রুমে গিয়ে পড়ে। রোদ-কুয়াশা-ধুলোর ঘ্রাণমাখা সেই ঘরের এক কোনায় তার চোখ আটকে যায় একটি অদ্ভুত আয়নার উপর। কালো কাপড়ে ঢাকা একটি নকশা করা আয়না।
অয়নার ফ্রেমটা পুরনো কাঠের তৈরি, তাতে খোদাই করা রয়েছে অচেনা কিছু প্রতীক, যা দেখে রিমার গায়ে এক অজানা কাঁপুনি বয়ে যায়। আয়নার কাঁচ ঝাপসা হলেও স্পষ্ট বোঝা যায়—এটা সাধারণ আয়না নয়। তবু কৌতূহলে ভরা মন তাকে বাধ্য করে আয়নাটিকে নিজের বেডরুমে এনে রাখার জন্য। অরুপ তখন অফিসে, তাই সে আয়নাটা বিছানার ঠিক বিপরীত দেয়ালে টানিয়ে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিমা নিজের মুখ দেখে, হালকা হেসে ওঠে, আর ভাবে, “আহা, কেমন যেন আরও সুন্দর লাগছে নিজেকে!”
রাতের খাবারের পরে অরুপ ফিরে আসে। ঘরে ঢুকে রিমাকে দেখে তার চোখে প্রেম ঝরে পড়ে। এই নতুন জীবনের শুরুতে তারা পরস্পরের আলিঙ্গনে নিজেদের জড়িয়ে ধরে—ভালোবাসায়, বিশ্বাসে, আশায়। রিমা হাসে, চোখে তার স্নিগ্ধ প্রশান্তি। অরুপ তার কপালে একটুকরো কাজলের টীকা দিয়ে বলে, “তোমার সুখে যেন কারো নজর না লাগে।”
হঠাৎ করে জানালা দিয়ে ঢোকা এক দমকা বাতাসে আয়নার উপর টানানো পাতলা পর্দাটা সরে যায়। ঘরের হালকা আলো আয়নার কাঁচে পড়ে, আর ঠিক সেই সময়, আয়নায় দেখা যায় রিমার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সেটা যেন একটু আলাদা। চুলের বিন্যাস এক, মুখের গঠনও এক, কিন্তু চোখদুটো—সেখানে যেন জমে আছে একরাশ হিংসা, একরকম হিংস্রতা। ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি, যেন স্নিগ্ধ ভালোবাসার সেই মুহূর্তকে উপহাস করছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—এই অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি শুধুমাত্র আয়নার ভেতরে। রিমা বা অরুপ কেউই তা দেখতে পায় না। তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সংসারের প্রেমে ডুবে থাকা দুজন মানুষ। শুধু আয়নার ভেতরে বসে থাকা সেই ‘অন্য রিমা’, সে দেখছে, সে জানছে—এই সংসারটা তার চাই।
রাত গড়িয়ে যায়। অরুপ গভীর ঘুমে। রিমা শুয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের নিঃশব্দতা যেন দপদপ করে কাঁপছে। হঠাৎ আয়নার ভেতর সামান্য একটা আলো ঝলকায়। যেন কেউ তার ভেতর থেকে তাকিয়ে রয়েছে, ডাকছে রিমাকে। কিন্তু রিমা তখনও তা টের পায় না। ঘুম আসছে না তার, শুধু অজানা এক অস্বস্তি গায়ে মেখে সে চোখ বন্ধ করে।
তবে আয়নার ওপার থেকে শুরু হয়ে গেছে সেই গল্প, যে গল্পে রিমা থাকবে, তবে তার জায়গা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবে আরেক রিমা—এক ভয়ানক ছায়া, যে ভালোবাসবে না, শুধু ছিনিয়ে নিতে চাইবে।
পরদিন সকালটা রোদ্দুরে ঝলমলে ছিল বটে, কিন্তু সেই আলোর নীচে ঘাপটি মেরে বসে থাকলো এক অন্ধকার—রিমার অজান্তেই।
পর্ব ২ – প্রতিচ্ছবি
সকালের নরম রোদটা জানালার ফাঁক গলে বিছানায় এসে পড়েছে। ঘুমচোখে রিমা তাকায় পাশের দিকে—অরুপ নেই। রান্নাঘর থেকে হালকা আওয়াজ ভেসে আসে। রিমা উঠে গিয়ে দেখে অরুপ নিজের জন্য কফি বানাচ্ছে। চুপিচুপি পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। অরুপ হেসে বলে, “মন খারাপ করিস না প্লিজ, দুটো দিনই তো। অফিসের কাজ না গেলে বেতনও আসবে না।” রিমা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, “তা ঠিক আছে… কিন্তু এই নতুন বাড়িতে একা থাকাটা কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।” অরুপ আদর করে কপালে একটা চুমু দেয়, “তুই সাহসী মেয়ে, তোর কিছু হবে না। আর আছি তো ফোনে—দিনে দশবার কল করবি।”
অরুপ চলে যায়। রিমা দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িটা যেন হঠাৎ আরও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। শব্দহীনতা আর নিঃসঙ্গতা মিলে এক অদৃশ্য ভার জমে ওঠে ঘরের বাতাসে। রিমা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর, পাখির ডাক, দূরের রাস্তায় কিছু গাড়ির শব্দ—সবকিছু স্বাভাবিক, অথচ যেন কিছু একটা ঠিকঠাক নেই।
দুপুরে স্নান সেরে এসে আয়নার সামনে বসে চুল শুকাতে থাকে রিমা। আচমকা সে থমকে যায়। তার চোখে পড়েছে আয়নার প্রতিচ্ছবির চোখদুটো। না, ওটা রিমার নিজের চোখ নয়। চোখদুটো যেন গভীর, কেমন যেন আঁধার মাখা, আর সেই চাহনিতে একটা অদ্ভুত ঘৃণা। ঠোঁটের কোণে একরকম ব্যঙ্গভরা হাসি। রিমা চমকে ওঠে। আবার ভালো করে তাকায়। এখন সব ঠিক আছে। আয়নায় সে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে, আগের মতোই। মনে মনে ভাবে—“হয়তো আজ মাথাটা একটু ভার লাগছে… কিছুই না।”
আয়নার সামনে থেকে উঠে সে ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরোনো আলমারি খুলে দাদুর জমানো কিছু জিনিস দেখতে থাকে। ধুলোয় মোড়া একটা কাঠের বাক্স খুলতেই ভিতর থেকে একটা পুরোনো কালো বই বেরিয়ে আসে। বইটার কালো মলাটে অদ্ভুত নকশা খোদাই করা—জ্যামিতিক, কিন্তু কেমন যেন অলৌকিক। তার মধ্যে একটি পরিচিত জিনিস চোখে পড়ে—একটা আয়নার চিত্র। রিমা হতভম্ব হয়ে পড়ে। আয়নার গঠন, খোদাই, ফ্রেম—সব এক। একেবারে হুবহু তার ঘরের আয়নার মতো।
বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা রয়েছে অচেনা ভাষায়—তাতে কিছু শব্দ ইংরেজি বা বাংলা নয়। পাণ্ডুলিপির মতো, যেন কোনও তন্ত্রগ্রন্থ। ছবি দেখে বোঝা যায়, আয়নাটা সাধারণ নয়। কয়েকটি চিত্রে আয়নার ভেতর থেকে হাত বেরিয়ে আসছে, কোথাও একটা নারী প্রতিচ্ছবি বাস্তব জগতে এসে দাঁড়িয়েছে, আর একজন বাস্তব নারী গিয়েছে আয়নার ভেতরে। রিমার ঠোঁট শুকিয়ে যায়। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপচাপ অনুভব করে।
সে বইটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। ঘরের নিঃসঙ্গতা যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। জানালার বাইরে রোদটা হারিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে একটা নীলচে স্যাঁতসেঁতে আলো ঘরে ঢুকে পড়ে। হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ, ফ্যানের শব্দের ফাঁকে একটা ঘর্ষণের আওয়াজ কানে আসে—যেন কেউ ধীরে ধীরে আয়নার কাঁচে নখ ঘষছে। রিমা চমকে তাকায়। আয়নায় কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু নিজের প্রতিচ্ছবিই। কিন্তু মন যেন বারবার বলছে—ওটা আয়না নয়, ওটা একটা দরজা।
সন্ধ্যে নামতেই আলো জ্বালিয়ে দেয় রিমা। বুকের ভেতর কেমন অজানা ভয়—অরুপের কথা খুব মনে পড়ছে। ফোনটা নিয়ে ডায়াল করে, অরুপের কণ্ঠ ভেসে আসে—“কি রে, ঠিক আছিস?” রিমা কিছু না লুকিয়ে বলে, “আজ আয়নার প্রতিচ্ছবি একটু অদ্ভুত লাগছিল…” অরুপ হাসে, “তুই আবার আয়না নিয়ে ভয় পাচ্ছিস নাকি? সেটা তোর দাদুর সংগ্রহ, দারুণ একটা পুরোনো জিনিস। হয়তো তোর মন খারাপ, সেটা থেকেই এইসব ভাবছিস।”
রিমা আর কিছু বলে না। ফোন রাখে। তার চোখ আয়নার দিকে আটকে থাকে। আয়নার ঠান্ডা কাঁচের ওপারে যেন জমে আছে একটা রহস্য, একটা হিংস্র আগ্রহ—যা সময়মতো জেগে উঠবে। আর রিমা তখন একা থাকবে…
পর্ব ৩ – ধোয়াশা
রিমা সকাল সকাল উঠে ঘর গুছিয়ে নেয়। কাল রাতে যা ঘটেছিল, সেটাকে স্বপ্ন বলে ভাবার চেষ্টা করে সে। আয়নার উপর কাপড়টা সে আগের রাতেই টেনে দিয়েছিল। মনে মনে ঠিক করে, যতদিন অরূপ না ফিরছে, ততদিন আয়নার সামনে সে যাবে না। একটু পরই ফোন আসে—অনামিকা আসছে তার সঙ্গে দেখা করতে। বহুদিন পর স্কুলজীবনের বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগে খুশি হয়ে ওঠে রিমা।
দুপুর নাগাদ অনামিকা এসে হাজির হয়। পরনে জিন্স আর টপ, হাতে একটা ছোট উপহার। জড়িয়ে ধরে বলে, “ম্যাডাম রিমা! দেখছিস, তোর বিয়েতে আসা হয়নি, কিন্তু আজ না এসে পারলাম না!” রিমা হাসে, “দিল্লির কাজের চাপ তো কিছু কম নয়, তুই এলি সেটাই অনেক।”
দুজন গল্পে মেতে ওঠে। রিমা চা বানাতে গেলে অনামিকা ঘর ঘুরে দেখে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, এক কোণে রাখা বিশাল আয়নাটা ঢেকে রাখা কাপড়ে ঢাকা। সে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে, “এত সুন্দর আয়নাটাকে ঢেকে রেখেছিস কেন?” চা হাতে ফিরে আসা রিমা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। গলা নামিয়ে বলে, “আসলে… আয়নাটাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না রে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার প্রতিচ্ছবি যেন… আমি নই।”
অনামিকা হেসে ওঠে, “আরে রিমা! তুই না আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি র্যাশনাল মেয়ে ছিলি? এখন কী এসব গাঁইয়ামি ভাবছিস? তোর দাদু তো নামজাদা কালেক্টর ছিলেন, এটা নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে আনা দামি কোনও প্রাচীন আয়না। তুই আজকাল একা একা থাকছিস, সেটা থেকেই এমন ভুলভ্রান্তি হচ্ছে।”
রিমা কিছু বলার আগেই অনামিকা কাপড় সরিয়ে দেয় আয়নার উপর থেকে। “এই আয়নাটা দারুণ লাগছে! চল একটা সেলফি নিই!” বলে সে আয়নার দিকে মোবাইল তোলে। আয়নায় তাকিয়ে দেখে সব স্বাভাবিক—নিজের চেহারা ঠিকঠাকই প্রতিফলিত হচ্ছে। অনামিকা বলল, “দেখ না তো, একবার আয়! দেখিস তোকে কেমন মানায় এই আয়নার সঙ্গে!”
রিমা ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় দেখে, সব ঠিকই আছে। আগের দিনের সেই হিংস্র চোখ, বিকৃত হাসির কোনও চিহ্ন নেই। বরং প্রতিচ্ছবি একদম শান্ত, স্বাভাবিক। নিজের চিন্তাধারাকে এক রকম ভুল ভেবে একটু লজ্জাও লাগে তার। সে গলা নামিয়ে বলে, “আসলে ওইদিন… মন খারাপ ছিল, তাই হয়তো এসব মনে হয়েছিল।”
অনামিকা হেসে বলে, “তুই না একদম ছেলেমানুষ হয়েই গেছিস। আজকের দিনে এসব বিশ্বাস করে কেউ?”
রিমা তারপর কথা ঘোরাতে গিয়ে বইটার কথা তোলে। বলে, “আচ্ছা তুই তো বিভিন্ন ভাষা জানিস, দেখ তো এটা বুঝতে পারিস কিনা।”
কালো বইটা হাতে নিয়ে অনামিকা অবাক হয়। “এই বইটা তো মনে হচ্ছে প্রাচীন লাতিন বা গ্রিক ভাষায় লেখা। দাঁড়া, AI অ্যাপে স্ক্যান করে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা।”
সে মোবাইলে ক্যামেরা চালু করে বইয়ের পাতার উপর ফোকাস করে। কিন্তু ক্যামেরা চালু হতেই হঠাৎ মোবাইলের স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে যায়। চমকে উঠে অনামিকা মোবাইল ঝাঁকায়। কিন্তু ফোন কিছুতেই অন হয় না। চার্জে দিলেও কোনও কাজ হয় না।
একটু আগেই তো সব ঠিক ছিল। ছবি তুললো তারা। অনামিকা একটু চিন্তিত হলেও হাসি মুখে বলে, “মোবাইলটা পুরোনো, বুঝলি। বহুদিন ধরে ভাবছিলাম বদলাবো, আজই মনে হচ্ছে শেষ দিন ছিল এটার। এই নিয়ে ভাবিস না। এই সুযোগে বরের পকেট মেরে একটা নতুন ফোন কিনে নেব।”
তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা রিমা, আমার এবার বেরোতে হবে। বরের অফিস টাইম শেষ হতে চলল। পরে আবার আসবো।”
রিমা একটু অবাক হয়। অনামিকা এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবেনি। তবে কিছু না বলেই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলে, “আয়। আবার আসিস।”
অনামিকা চলে যেতেই রিমা নিজের কাজে ডুবে যায়। দাদুর কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার সময় কখন যে আয়নার ঢাকনা দেওয়া হয়নি, সেটা খেয়ালই থাকে না তার।
ঘরজুড়ে তখন একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। জানালার পর্দা হালকা হাওয়ায় দুলছে। আয়নার কাচে ধুলোমাখা আলো ছায়া খেলে যাচ্ছে। কিন্তু আয়নার ভেতরে প্রতিচ্ছবি স্থির নয়। অন্ধকার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে আবার সেই বিকৃত হাসি। এবার আর কেবল চোখে হিংসা নয়, চোখে একধরনের বিজয়ের ঝিলিক। যেন সে অপেক্ষায় আছে… কবে আসবে সেই রাত, যখন সে আয়নার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে।
পর্ব ৪ – রূপ বদল
রাত গভীর। জানালার কাঁচে পড়ছে নিঃসঙ্গ চাঁদের আলো। বাতাসে হালকা একটা শীতলতার পরশ। হঠাৎ এক চাপা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রিমার। চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসতেই গা ঠান্ডা হয়ে আসে তার—বিছানার একধারে বসে আছে আরেকজন মেয়ে। একেবারে হুবহু রিমার মতো দেখতে। মুখ, চোখ, চুল, এমনকি রাতের নীল নাইটি পর্যন্ত এক।
রিমা প্রথমে ভাবে হয়তো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু না, মেয়েটির ঠান্ডা চোখে তাকানো, নিঃশ্বাসের শব্দ—সব বাস্তব। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে যায় তার। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি?”
মেয়েটি ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায়। চোখে একরাশ আত্মবিশ্বাস আর বিদ্রুপ। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। সে বলে, “আমি তুই। শুধু আয়নার ওপার থেকে এসেছি। এতদিন তোকে দেখেছি, এবার তোর জায়গা আমায় দিতে হবে।”
রিমা হকচকিয়ে ওঠে, “কি বলছো তুমি? এটা কেমন বাজে রসিকতা?”
মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়ায়। চুলটা একবার ঝাঁকিয়ে সিঁথি সামলায়। রিমা বিস্ময়ে দেখে—তার সিঁথি ডান পাশে, কিন্তু এই মেয়ের বা পাশে। আরও অবাক হয়, যখন লক্ষ্য করে—নিজের গলার বাঁদিকে যে ছোট্ট একটা পুরোনো কাটা দাগ আছে, সেটা মেয়েটির গলার বাম পাশে নেই, বরং ডান পাশে দাগ রয়েছে।
এইসব ছোটখাটো পার্থক্যেই রিমা বুঝতে পারে, মেয়েটি আসল নয়—তার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কীভাবে সে বাস্তবে এসেছে? এমন কিছু তো হবার কথা নয়! রিমা পেছনে সরতে চায়, কিন্তু বিছানার ধারে এসে মেয়েটি বলে, “আজ থেকে তোর জীবন আমার। তোর স্বামী, তোর সংসার—সব আমার। তুই আয়নায় থাকবি, আর আমি তোর হয়ে থাকবো এই পৃথিবীতে।”
এই বলেই প্রতিচ্ছবি এক ঝটকায় রিমাকে ধরে আয়নার দিকে ঠেলে দেয়। এক অদ্ভুত আলো ঝলসে ওঠে মুহূর্তে। রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
তারপর—ঘুটঘুটে অন্ধকার।
রিমার জ্ঞান ফেরে ধীরে ধীরে। মাথা ভারী, শরীর ঝিমঝিম করছে। সে চোখ মেলে তাকাতেই চমকে ওঠে। চারপাশ পরিচিত, কিন্তু আবার অচেনা। ঘরটা যেন আগের মতোই, অথচ কোথায় যেন কিছু একটা আলাদা। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরটা খেয়াল করে—বামদিকের দেয়ালে যে আলমারি ছিল, সেটা এখন ডানদিকে। ডানদিকে যে টিভি ছিল, সেটা এখন বাঁদিকে। সব যেন আয়নার প্রতিবিম্ব।
হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ যায় রিমার। সে চমকে ওঠে—আয়নায় দেখা যাচ্ছে তার স্বামী অরুপ, আদর করছে তাকে। কিন্তু আয়নার ওপারে সে নয়, আরেকজন!
নকল রিমা!
রিমা ছুটে যায় আয়নার সামনে। চিৎকার করে ডাকে, “অরুপ! আমি রিমা! ও না! ও আমি না!” কিন্তু আয়নার ভেতর থেকে তার আওয়াজ বাইরে পৌঁছায় না। সে শুধু দেখতে পায়, বাইরে অরুপ হাসিমুখে কথা বলছে, আর পাশে বসে থাকা ‘রিমা’ তাকে ভালোবাসার ছায়া দিচ্ছে।
হঠাৎ সেই নকল রিমার চোখ পড়ে আয়নার দিকে। সে একবার চোখ পাকিয়ে তাকায় আয়নার রিমার দিকে, তারপর আবার হেসে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। রিমা হতভম্ব হয়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পরের দিন দুপুরে অরুপ অফিসে চলে গেলে নকল রিমা ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এক শয়তানি হাসি ফুটিয়ে তোলে। তারপর ধীরে ধীরে আয়নাটা তুলে নিয়ে চলে যায় স্টোর রুমে।
আসল রিমা কান্নাভেজা চোখে দেখে, আয়নার সামনে থেকে আলো-আঁধারির খেলা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলে, “না! আয়নাটা সরাবি না! আমি এখনও বেঁচে আছি!” কিন্তু কিছুই থামানো যায় না।
স্টোর রুমের অন্ধকারে রাখা হয় আয়নাটা, একটা পুরোনো কাঠের আলমারির কোণায়। আয়নার কাচ ধীরে ধীরে ধুলোয় ঢেকে যায়। আর তার ভিতরে বন্দি হয়ে যায় এক জীবন্ত প্রাণ—রিমা।
কিন্তু আয়নার কাচের নিচে, মাঝেমধ্যে হালকা নিঃশ্বাসের ধোঁয়া জমে ওঠে… যেন ভিতরে এখনও কেউ শ্বাস নিচ্ছে। অপেক্ষায় আছে—কারও চোখ আবার আয়নার দিকে পড়বে কি না, কেউ বুঝবে কি না তার এই ভয়ানক বন্দিদশার কথা…
পর্ব ৫ – আসল নকল
বিয়ের পরের প্রথম কয়েকটি সপ্তাহ যেন স্বপ্নের মতো কেটেছিল। রিমা ও অরুপের সংসার ছিল হাসি, মিষ্টি অভ্যাস আর রোজকার ভালোবাসার ছোট ছোট মুহূর্তে ভরা। কিন্তু অরুপ ধীরে ধীরে লক্ষ্য করতে লাগল, রিমা যেন আর আগের রিমা নেই।
প্রথম সন্দেহ আসে রান্না নিয়ে। রিমা যে রান্না করত, তাতে ছিল মায়ের হাতের ঘ্রাণ, নিজস্ব টেস্ট। অরুপের মায়ের শেখানো ঝোল কিংবা রিমার নিজের বানানো পনিরের তপ্ত ঝাঁজ—সব কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে উঠল। স্বাদে যেন প্রাণ নেই, ভালোবাসার ছোঁয়া নেই।
কথাবার্তাতেও যেন পরিবর্তন। রিমা আগে যেমন সবকিছু নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতো, অরুপের বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বলত, নিজের মা-বাবার খোঁজ নিত—তা এখন নেই। এখন সে প্রায় সবসময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। একা একা বারান্দায় বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনও আপন মনে হাসে, কখনও নিজেকে নিয়ে কথা বলে।
একদিন রাতে, হঠাৎ করে ছাদে গিয়ে রিমা একা একা নাচতে থাকে। প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা জানালা দিয়ে দেখে চমকে যান। পরদিন সকালেই অরুপকে সব জানায় তিনি। অরুপ প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, রাতের বেলা নিজেই দেখে ফেলে রিমার ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে।
সেই রাতেই অরুপ জিজ্ঞেস করে, “রিমা, তুই ঠিক আছিস তো? এসব কি করছিস?”
রিমা হেসে বলে, “আমি কল্পনায় আমার পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা বলি। তারা আমাকে দেখতে আসে, গল্প করে… খুব ভালো লাগে।”
অরুপ ভাবে, হয়তো এটা রিমার কোনো রোমান্টিকতা। হয়তো একাকিত্বের ছাপ। তবু কোথাও গিয়ে তার মনে খচখচ করতে থাকে—এই রিমা যেন সেই রিমা নয়।
সন্দেহ আরও গাঢ় হয়, যেদিন রিমার প্রিয় বন্ধু অনামিকা হঠাৎ এসে হাজির হয়।
“এই তুই তো পুরো পাল্টে গেছিস রে রিমু!” — হাসতে হাসতেই বলে অনামিকা।
রিমা কেমন যেন সংযত হাসি হেসে বলে, “তুই তো অনেকদিন পর এলি। আমি তো ভালোই আছি।”
অনামিকা জিজ্ঞেস করে, “তোর সেই সীতাহারটা কোথায় রে, একবার দেখা তো, ডিজাইনটার ছবি তুলে দোকানে বানাতে দেব।”
এই শুনেই রিমার মুখ থমকে যায়। চোখ এক ঝলকে হালকা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। সে জবাব দেয়, “ওটা… ওটা আমি সিন্দুকে তুলে রেখেছি… এখন বার করা যাবে না।”
অনামিকা একটু অবাক হয়। তারপর চোখ পড়ে দেয়ালে, যেখানে সেই পুরোনো আয়নাটা ছিল।
“এই আয়নাটা কোথায় গেল? সেটার তো খুব গর্ব করতিস তুই।”
রিমা গলায় কাঁপা হাসি এনে বলে, “ভেঙে ফেলেছি। ওটা ভালো ছিল না।”
এই কথায় অনামিকার বুকের ভেতর একঝলক ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায়। তার মনে পড়ে, আগেও একদিন রিমা বলেছিল আয়নাটা ‘বিরক্তিকর’… এখন আবার বলছে ভেঙে দিয়েছে। অথচ সেই আয়নাটি ছিল বহু পুরোনো, দামি এবং ঐতিহাসিক এক সংগ্রহ। হঠাৎ করে এমন কাজ কেন করবে রিমা?
অনামিকা একটু ঠান্ডা মাথায় বলে, “আচ্ছা, আমি তাহলে আজ উঠি। পরে আবার আসব।”
বেরোনোর সময় পেছন ফিরে আর একবার রিমার দিকে তাকায় অনামিকা। তার দৃষ্টিতে ছিল মিশ্রণ—স্নেহ, কৌতূহল আর গভীর সন্দেহ।
রিমা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে অনামিকার চলে যাওয়া। ঠোঁটে এক বিন্দু ঠান্ডা হাসি। চোখে চূড়ান্ত সতর্কতা।
সে জানে—অনামিকা কিছু একটা টের পেয়েছে। আর সেই সন্দেহ থেকেই যাবে।
কিন্তু এই সংসার, এই জীবন, এই রূপ—সব তো এখন তার। কিছুতেই আর হারাতে দেবে না সে।
অন্যদিকে, আয়নার ভিতরে বন্দি আসল রিমা তার চারপাশে হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে…
কিন্তু… কেউ শোনে না।
পর্ব ৬ – সন্দেহ
রাত গভীর। শহরের ঘুমন্ত বারান্দা-ঘেরা একটি গলিতে হঠাৎ এক ফিসফিসে কান্নার শব্দে জেগে ওঠে অনামিকা। সে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে চমকে যায়—দেখে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে রিমা। তার চুল এলোমেলো, মুখে চাপা আতঙ্ক আর ক্লান্তির ছাপ।
“রিমু? তুই এখানে?” — অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অনামিকা।
রিমা ধীরে ধীরে মুখ তোলে। চোখ ভেজা। কণ্ঠস্বর কাঁপা। “অনু… আর পারছি না রে। অরুপ… ও আমায় মারে। খেতে দেয় না। দিনের পর দিন কথা বলে না… আমি ভেঙে পড়েছি…”
অনামিকার মাথায় ঘুরে ওঠে। অরুপ এমন কিছু করতে পারে, তার ধারণা ছিল না।
সে এগিয়ে এসে রিমার কাঁধে হাত রাখে। “চল ঘরে, ভিতরে বসে কথা বলি।”
কিন্তু রিমা মাথা নেড়ে বলে, “আমি আর কারোর বাড়ি যেতে চাই না। এইখানেই সব বলে যেতে চাই।”
কথা বলতে বলতে, তারা বারান্দার রেলিং-এর কাছে চলে আসে। রিমার মুখে কষ্ট, চোখে জল—সবকিছু এতটাই বাস্তব যে, অনামিকা একটুও সন্দেহ করে না।
ঠিক তখনই—
একটা অপ্রত্যাশিত ধাক্কা।
আচমকা রিমা এক হাত দিয়ে অনামিকাকে রেলিং-এর ওপর ঠেলে ফেলে দেয়। অনামিকা কিছু বোঝার আগেই দোতলার বারান্দা থেকে নিচে পড়ে যায়। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এক হৃদয়বিদারক চিৎকার।
সেই চিৎকারে বাড়ির অন্যান্যরা ও প্রতিবেশীরা জেগে ওঠে, কেউ কেউ নিচে দৌড়ে যায়।
কিন্তু তার আগেই, রিমা নিঃশব্দে গা ঢাকা দেয়। আর কোনো শব্দ নেই, কেবল বাতাসে তার জোরে হাসার প্রতিধ্বনি যেন থেকে যায়।
ভোরে খবর পৌঁছায় অরুপের কাছে। রিমাকে জানায় সবকিছু। রিমা অবাক হয় না। সে যেন আগে থেকেই সব জানে। অনামিকাকে দেখতে হাসপাতালেও যেতে অস্বীকার করে। অরুপ একাই ছুটে যায় হাসপাতালে। অনামিকা বেঁচে আছে, কিন্তু সংকটজনক অবস্থায়। মুখে বলতে পারছে না কিছু, শুধু ঘাড় বাঁকিয়ে গোঙাচ্ছে।
ডাক্তাররা জানায়, হয়তো মাথায় চোট লেগেছে। কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে।
তবুও, অনামিকার মুখে কয়েকটা অস্পষ্ট শব্দ ফুটে ওঠে—“আয়না… রিমা… কালো বই…”
এই কয়েকটি শব্দ যেন বাজ পড়ে অরুপের মাথায়। তার মনের সেই খচখচে সন্দেহ এক লাফে দগদগে হয়ে ওঠে।
সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, কিছু একটা লুকিয়ে আছে এই আয়নার রহস্যে। রিমা আর রিমা নেই।
বাড়িতে ফিরে অরুপ লক্ষ্য করে—ঘরের পরিবেশ অস্বাভাবিক শান্ত। রিমা রান্নাঘরে। কিন্তু তার নড়াচড়া, মুখের অভিব্যক্তি, চোখের দৃষ্টি… সবকিছু যেন কৃত্রিম।
তার চুলের বিনুনি আগের মত নয়, সে আজকাল পছন্দ করে লাল লিপস্টিক, অথচ আগে রিমা ব্যবহার করত কেবল হালকা রঙের লিপবাম।
তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, “মানুষ বদলায় অরুপ। তুমিই তো বলেছিলে, নতুন রিমা যেন নতুন হয়ে ওঠে।”
অরুপ কোনো উত্তর দেয় না। তার মনে কেবলই ঘুরতে থাকে সেই তিনটি শব্দ—আয়না, রিমা, কালো বই।
পর্ব ৭ – বিপদের বন্ধু
অরুপ যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। প্রতিদিনের বদলে যাওয়া রিমার ব্যবহার, অনামিকার দুর্ঘটনা, আর আয়নার চারপাশে ঘিরে থাকা অদৃশ্য আতঙ্ক—সব মিলিয়ে তার ভিতরে ভয় আর দুশ্চিন্তা জমাট বাঁধছিল। আর তাই সে ছুটে গেল সেই বন্ধুর কাছে, যাকে একসময় কলেজজীবনে প্রায়ই নিয়ে হাসাহাসি করত। যার প্রেতচর্চা, অদ্ভুত বই আর তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে অরুপ আর তার বন্ধুরা মজা করত, আজ তারই দরজায় এসে দাঁড়াতে হলো অরুপকে।
বন্ধু দরজা খুলেই হাসলো, ঠোঁটে বিদ্রুপ মেশানো সুর, “তোরা বলতিস—প্রেতাত্মা, পরলোক, পুনর্জন্ম, এসব বাজে বুজরুকি। স্মার্ট মানুষ এসব বিশ্বাস করে না। এখন কী হলো? তুই নিজেই আমার কাছে এসেছিস?”
অরুপ মাথা নিচু করে বললো, “ভুল করেছি রে। এখন বোঝাতে পারব না। শুধু বলি, আমি ভয় পাচ্ছি। আমার বউটা… সে আর আগের মতো নেই। আমি নিশ্চিত, সে রিমা না।”
বন্ধুর মুখ গম্ভীর হলো। সে বলল, “শোন, আমি বিজ্ঞান মানি, কিন্তু এটাও মানি যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যার রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। আমি তোকে সাহায্য করবো। তবে একটা শর্ত আছে—তোর অনুমতি নিয়ে আমি আগে তোর বাড়ির স্টোর রুমটা দেখতে চাই। আয়নাটার উৎস বুঝতে হবে। তুই তোর বউকে নিয়ে একদিন কোথাও বেড়িয়ে আয়। আমি তখনই ও ঘরে কাজ শুরু করবো। তবে সাবধানে থাকবি। সবসময় ওকে নজরে রাখবি।”
পরদিন অরুপ ‘রিমা’কে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলল। প্রথমে কিছুটা অনিচ্ছা দেখালেও পরে নকল রিমা রাজি হয়ে গেল। অরুপ বুঝল, সে কিছু আঁচ করেছে, কিন্তু নিশ্চিত নয়। তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। অন্যদিকে, অরুপের বন্ধু চাবি দিয়ে প্রবেশ করল তাদের বাড়িতে।
বাড়ির ভিতর যেন এক ছায়া ছড়িয়ে আছে। স্টোর রুমের সামনে দাঁড়িয়েই সে বুঝল, কিছু একটা ভয়ানক কিছু আছে এখানে। ধীরে ধীরে দরজা খুলল সে। ভিতরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আয়নাটাকে খুঁজতে শুরু করল। অনেকটা সময় পর, সিন্দুকের এক কোণে কাপড়ে মোড়ানো সেই আয়নাটা দেখতে পেল।
আয়নাটাকে স্পর্শ করতেই তার শরীরে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে অনুভব করল, কেউ যেন তার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে চোখ রেখে কাঁদছে। সে আয়নার দিকে তাকাল। সেখানে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এমনকি তার নিজের প্রতিবিম্বও না। কিন্তু একটা আবেগ, একটা অদৃশ্য কান্না যেন তার হৃদয় ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
বন্ধু ধীরে ধীরে আয়নাটা তুলে হাতে নিল। আয়নার সংস্পর্শে সে যেন কারো হালকা উপস্থিতি অনুভব করল। ঠিক সেই মুহূর্তেই, বহু মাইল দূরে বেড়াতে যাওয়া নকল রিমার শরীর কেঁপে উঠল। সে আচমকা বলল, “আমার শরীর ভালো লাগছে না। এখনই বাড়ি যেতে হবে।”
অরুপ চিন্তিত চোখে তাকাল, “রাত হয়ে গেছে। সকাল হলে না হয়—”
“না!” রিমার চোখ চকচক করছে। “আমি এখনই যাব। এই মুহূর্তে।”
অরুপ ভয় পেয়ে গেল। এইভাবে সে আগে কখনো এমন দেখেনি রিমাকে। গলায় যেন আর রিমার সেই পরিচিত কোমলতা নেই, বরং আছে হিংস্রতা আর চিৎকার চেপে রাখা এক তীব্র হুমকি। অরুপ চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট করল। তারা ফিরতে লাগল বাড়ির দিকে।
অন্যদিকে, অরুপের বন্ধু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কালো মোড়ক সরিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করেছিল ঠিক তখনই। আয়না যেন কাঁপতে শুরু করল। ভিতর থেকে যেন কোনো কান্না, কোনো অস্পষ্ট ছায়া বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে জানত, সময় অল্প। নকল রিমা টের পেয়েছে—তার আয়না অন্য কারও হাতে।
পর্ব ৮ – ফিরে আসার আলো
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেমে যেতেই দরজা খুলে পাগলের মত দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল নকল রিমা। অরুপ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায় বাড়ির ভেতরে। অরুপ ছুটে পেছন পেছন ঘরে ঢুকতেই দেখতে পায়—স্টোর রুমের দরজাটা হাট করে খোলা, আর ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে তার সেই প্রেতচর্চার বন্ধু, দুহাতে ধরা সেই পুরোনো রহস্যময় আয়না। তার গলায় ঝুলছে কালো সুতোয় বাঁধা অদ্ভুত এক পাথর।
নকল রিমার উদ্দেশ্যে অদ্বিত কড়া গলায় বলে ওঠে, “অনেক দিন তো স্বাধীনতা ভোগ করলি তুই। এখন ফিরে যা তোর আসল জায়গায়। ভালোভাবে যাবি, না যন্ত্রণা ভোগ করে যাবি—সেটা তোর উপর।”
এই কথাটা শুনতেই ভয়াল রূপ ধারণ করে নকল রিমা। চোখ লাল হয়ে ওঠে, দাঁত বেরিয়ে আসে বাঘিনীর মতো, চুল এলোমেলো, মুখটা বিকৃত। সে আর মানুষ থাকে না। এক লাফে সে ছুটে আসে অদ্বিতের দিকে, যেন পাখির মতো উড়ে।
কিন্তু ঠিক তখনই অদ্বিত সামনে মেলে ধরে সেই কালো বইটা। বই খুলেই জোরে উচ্চারণ করে অজানা এক ভাষার তন্ত্রমন্ত্র। সাথে সাথেই বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ঘরের বাতাস যেন ঘুরপাক খেতে থাকে, জানলার কাঁচ কেঁপে ওঠে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে উড়ন্ত নকল রিমা ছিটকে পড়ে ঘরের এক কোণের দেওয়ালে।
ঘরের বাতি ঝাঁপট খায়। নকল রিমা দাঁত নখ বের করে আবারও উঠে দাঁড়ায়। এবার তার রুদ্ররূপ আরও বিভীষিকাময়। সে আবার লাফ দেয়, এইবার আরও ক্ষিপ্রতায়। কিন্তু বন্ধুর মন্ত্রোচ্চারণ থামেনি। তার কণ্ঠে সেই অজানা ভাষার মন্ত্র গর্জনের মতো বেরিয়ে আসে। নকল রিমা আবারও ছিটকে পড়ে—এবার ঘরের অন্য প্রান্তের দেওয়ালে।
তারপর সে দেওয়াল বেয়ে উলটো হয়ে ছুটতে থাকে, এক কোণ থেকে আরেক কোণে, ছাদের উপর দিয়ে, যেন এক অশুভ প্রেতাত্মা। তার চিৎকারে কাঁপতে থাকে ঘর। জানলা-দরজা একে একে বন্ধ হয়ে যায়। বাতি নিভে গিয়ে আবার জ্বলে ওঠে।
অরুপ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখের সামনে ঘটে চলেছে এমন এক ঘটনা, যা সে কখনও কল্পনাও করেনি। অদ্বিতের কণ্ঠে ততক্ষণে আরও তীব্র হয়েছে মন্ত্রের ধারা। ঘরের মাঝখানে তৈরি হয়েছে এক ঘূর্ণিবায়ুর কেন্দ্র। অদ্বিতের হাত থেকে ছিটকে চলে আসে সেই আয়নটা ঘুর্ণির মাঝখানে। ধীরে ধীরে দুলতে থাকে সেই রহস্যময় আয়নাটি।
হঠাৎ, সেই আয়নার ভেতরে ঝলকে ওঠে এক আলো । আর তার মধ্য থেকে ফুটে ওঠে রিমার এক ঝাপসা অবয়ব। ধীরে ধীরে মুখটা স্পষ্ট হয়। সত্যিকারের রিমা। ক্লান্ত, চোখে অশ্রু, কিন্তু জীবিত।
এদিকে নকল রিমা—এখন যেন শেষ ধাপে পৌঁছেছে। তার চোখে আগুন, মুখে বিকৃত হাঁসি। সে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসে আয়নার দিকে। শরীর তার কাঁপছে। চুল এলোমেলো, হাঁফাতে হাঁফাতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর এক ঝাপটা ধোয়ার মতো সে গলে গিয়ে ঢুকে পড়ে আয়নার ভিতরে।
এক মুহূর্ত সব নিস্তব্ধ।
তারপর সেই আয়নার ভিতর থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতি বেরিয়ে আসে। আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় অরুপের। সেই আলোর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে আসল রিমা। ক্লান্ত, নিঃশেষ, কিন্তু মুক্ত।
সে যেন বাইরে পা দিয়েই ঢলে পড়ে। অরুপ ছুটে যায়, তাকে জড়িয়ে ধরে। রিমা চোখ মেলে তাকায় অরুপের দিকে। তার ঠোঁট কাঁপে, চোখে জল। সে বলে, “আমি ফিরে এসেছি…”
অদ্বিত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আয়নার সামনে। আয়নাটাকে আবারও কালো কাপড়ে মুড়ে ফেলে। অরুপ কিছু বলতে গেলে সে থামিয়ে দেয়, “সবকিছু ঠিক হয়েছে। তবে এই আয়নাকে আর কখনো খোলা যাবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি এটা।”
তারপর ধীরে ধীরে, সেই রহস্যময় কালো কাপড়ে ঢাকা আয়নাটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে—নিঃশব্দে। পিছনে ফেলে যায় এক ভয়াবহ স্মৃতির ধূসর ছায়া।