বিশেষ ঘোষণা : এটি একটি কাল্পনিক গল্প। বাস্তব কোনো ঘটনার সাথে এর কোনো মিল নেই। যদি কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়, সেটি অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
পর্ব ১: প্রতিবাদের প্রথম ধ্বনি
“এই পৃথিবীকে একটি শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, প্রাণপণে সরাব জঞ্জাল”—
কিশোর বিদ্রোহী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কবিতা ইশানী কখনও পড়ে নি। কারণ সে বাংলা ভাষা জানে না। সে ভারতের কেউ না। ইশানী জয়সিংহ। শ্রীলঙ্কার এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের বাড়ি। ছোট্ট মাটির ঘর, পেছনে বাঁশঝাড়, পাশে একটা ক্ষীণ জলের খাল। বাবা সারাথ জয়সিংহ এবং মা গীতা কাঁথা সেলাই করে দু’পয়সা উপার্জন করেন। সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তবুও ইশানীর মুখে কোনদিন ক্লান্তির ছায়া পড়ে না। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে — স্বপ্নে, লড়াইয়ে, আর আশায়। তার স্বপ্ন কবি সুকান্তের এই কবিতার কথার সাথে মিলে যায়। পৃথিবীকে দুর্নীতিমুক্ত করাই তার স্বপ্ন।
সে গ্রামে যে স্কুলে পড়ে, সেটিও খুব সামান্য এক কাঠের ঘর। বর্ষাকালে জল পড়ে ক্লাসরুমে, গরমে ছাদে পলিথিন টাঙিয়ে পড়াশোনা চলে। শিক্ষকরা চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে ইশানীর জন্য এসব কোনো বাধা নয়। পুরনো বই জোগাড় করে, পুরনো প্রশ্নপত্রে অনুশীলন করে সে নিজেই নিজের শিক্ষক।
ইশানীর বয়স মাত্র ষোলো, কিন্তু মন যেন ষাট বছরের একজন চিন্তাশীল সমাজসংস্কারকের মতো। যখন অন্য মেয়েরা বিয়ে, মেহেদি আর গয়নাগাঁটি নিয়ে স্বপ্ন দেখে, ইশানী তখন চোখে স্বপ্ন দেখে একটি ইউনিফর্মের — পুলিশ অফিসারের পোশাক। DIG বা IGP অফিসার হয়ে সে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে, শ্রীলঙ্কা থেকে সমস্ত জঞ্জাল দূর করবে।
ঘটনাটা ঘটে একদিন দুপুরে, গরমকাল। মে মাসের শেষ সপ্তাহ। ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েরা তাদের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি। গরমে কারও পড়াশোনার মন নেই, তবুও গ্রাম্য লাইব্রেরি ঘরের বাইরে ছেলেমেয়েরা বসে চুপচাপ পড়ছে। হঠাৎ করেই পাশের মাঠে শুরু হয় এক বিশাল রাজনৈতিক সভা। সেই সভার আয়োজন করেছে গ্রামের প্রধান দায়ানান্দ হেরাথ। নির্বাচনের আগে গ্রামের মানুষকে খুশি করতে ও নিজের প্রভাব দেখাতে এই সভা আয়োজন করা হয়েছে।
গায়ে চাঁদি গলানো ধুতি, গলায় সোনার চেন, আর হাতে মোটা মোবাইল — দায়ানান্দ হেরাথ যেন এই গ্রামের রাজা। তার সঙ্গে এসেছে কয়েকজন নেতার অনুগামী, মাইকের দোকান থেকে বড় সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করে এনে মাঠের মাঝখানে লাগানো হয়েছে। বিকট শব্দে শুরু হয় ফিল্মি গান, তারপর বক্তৃতা — রাজনীতি, উন্নয়ন, আর নিজেদের প্রশংসার ছড়াছড়ি।
গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা চুপচাপ বই নিয়ে সরে যেতে থাকে, মাথা নিচু করে। কেউ প্রতিবাদ করে না, কারণ সবাই জানে — দায়ানান্দ হেরাথ মানে ক্ষমতা। তার নামে কেউ মুখ খোলে না, কারণ তাতে বিপদ হতে পারে। কিন্তু ইশানী চুপ থাকে না।
সে প্রথমে গিয়ে সভার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে। তার চোখে রাগ, মুখ শক্ত। পাশে দাঁড়ানো এক ছাত্রী বলল, “থাক ইশানী, কিছু বলিস না। কেউ শুনবে না।”
কিন্তু ইশানী এগিয়ে যায়। হেঁটে যায় মাইকের সামনে, সভার মাঝখানে। প্রথমে কেউ খেয়াল করে না, কিন্তু হঠাৎ সে মাইকের প্লাগ টেনে ছিঁড়ে ফেলে।
গোটা মাঠ নিস্তব্ধ।
সবাই থমকে যায়। দায়ানান্দ হেরাথ রেগে উঠে বলে, “কে তুই? কিসের সাহস তোর?”
ইশানী গলা উঁচু করে বলে, “আমি একজন ছাত্রী। এই গ্রামের একজন বাসিন্দা। আপনার সভার শব্দে আমরা পড়তে পারছি না। পরীক্ষার সময় এমন গান বাজিয়ে সভা কেন করবেন? শিক্ষার চেয়ে বড় কি কিছু আছে?”
পেছনে লোকজন গুঞ্জন শুরু করে। কেউ কেউ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে — এমন সাহস তো আগে কেউ দেখায়নি।
দায়ানান্দ হেরাথ রাগত স্বরে বলে, “তোদের পড়াশোনার দায় আমার না! আমি উন্নয়নের কথা বলছি, তোর কী সমস্যা?”
ইশানী বলে, “আপনার উন্নয়ন যদি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি করে, তাহলে সেই উন্নয়ন চাই না। এটা জনসভার নাম করে নিজের প্রচার। আপনার কথা শুনতে আমাদের কেউ রাজি নয়। দয়া করে সভা বন্ধ করুন। নয়তো আমি পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দেব এই অন্যায়ের খবর।”
গোটা মাঠে একটা চাপা উত্তেজনা। দায়ানান্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সে বুঝে যায়, এই মেয়েকে এখন কিছু করলে উল্টো ক্ষতি হবে। স্থানীয় এক শিক্ষক তখন কাছে এসে বলে, “ঘটনা সত্যি, বাচ্চারা পড়তে পারছে না। সভা পরে করলে ভাল হয়।”
অবশেষে দায়ানান্দ হেরাথ সভা বন্ধ করেন। মাইক খুলে নেওয়া হয়। সভাস্থল ফাঁকা হয়ে যায়।
পরদিন গ্রামের স্কুলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু — ইশানী। শিক্ষকরা, সহপাঠীরা, এমনকি অনেকে অভিভাবকরাও বলে, “ও মেয়েটা সাহসী, ওর মতো আরো অনেকের হওয়া উচিত।” কেউ কেউ আবার ভয় পায় — “এইভাবে পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে গেলে বিপদে পড়বে না তো?”
কিন্তু ইশানী ভয় পায় না। সে বলে, “যে সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই ভয় দেখানো হয়, সেই সমাজেই বিপ্লবের দরকার।”
সেই দিন থেকে ইশানী হয়ে ওঠে গ্রামের সাহসের প্রতীক। সে শুধু একজন মেয়ে নয়, এক আশার প্রতীক। স্কুলের পুরনো লাইব্রেরি ঘরটা এবার নিয়মিত খোলার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সন্ধ্যায় পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। তার উদ্যোগে গ্রামের আরও মেয়েরা স্কুল ছাড়ার কথা ভুলে যায়, পড়াশোনায় উৎসাহ পায়।
পর্ব ২: সিংহাসনের আড়ালে শকুনেরা
শহরের নামী কলেজ। দূর দূর থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে এখানে। কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রনোজিৎ রণতুঙ্গা — কলেজের অঘোষিত সম্রাট। বয়সে তরুণ হলেও তার চোখেমুখে এক ধরনের শকুনের দৃষ্টি, যা কেবল সুযোগ খোঁজে। সে কোনো সাধারণ ছাত্রনেতা নয়; তার পেছনে রয়েছে শাসকদলের আশীর্বাদ, এবং শহরের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর প্রকাশ্য সমর্থন। সে কলেজকে নিজের ব্যক্তিগত এলাকা ভেবে চলে।
রনোজিৎ রণতুঙ্গার একটা ‘গ্যাং’ রয়েছে — তার ঘনিষ্ঠ কিছু অনুগামী যারা ক্লাসে যায় না, বই ছুঁয়েও না, কিন্তু প্রতিদিন কলেজে হাজির থাকে। তাদের হাতে থাকে দামী মোবাইল, চোখে রোদচশমা, মুখে গালাগালি, আর পকেটে থাকে ভয় ও ক্ষমতার ভাষা।
কলেজের পিছনের বাঁধানো দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায়শই দেখা যায় কিছু ‘লুকানো লেনদেন’। বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও ছাত্রছাত্রীরা জানে — ওগুলোই মাদকের কারবার। নতুন ছেলেমেয়েদের ফাঁদে ফেলে রনোজিৎ-এর গ্যাং তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার মাদক বিক্রি করায়। কেউ না করতে চাইলেই শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার।
শুধু তাই নয়, কলেজে নানা অজুহাতে চাঁদা তোলা হয় — কখনও ক্যালেন্ডার ছাপানো, কখনও ফেস্ট, কখনও ‘ইউনিয়ন ফান্ড’। এইসবের কোনোটারই বাস্তবিক হিসাব নেই। কারো ২০০, কারো ৫০০ টাকা… কেউ না দিলে তার ফল ভোগ করতে হয়।
একজন প্রফেসর মৃদুভাবে একবার বিরোধিতা করেছিলেন। তার ক্লাসে ইচ্ছাকৃত চিৎকার করে ঢুকে পড়ে রনোজিতের গ্যাং। পরের দিন তার গাড়ির চাকা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ভয়ে তিনি আর কিছু বলেননি।
রনোজিৎ রণতুঙ্গা এবং তার লোকেরা সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে কলেজের ছাত্রীদের জন্য। ক্লাস চলাকালীন পেছনের বেঞ্চে বসে ছাত্রীদের দিকে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া, তাদের ছবি তুলতে যাওয়া, করিডোরে ইচ্ছে করে ধাক্কা দেওয়া — এসব যেন রোজকার চিত্র।
অনেক ছাত্রী ভয়ে ক্লাসে আসা বন্ধ করে দেয়। কেউ বা অভিভাবকের সঙ্গে এসে অভিযোগ জানায়, কিন্তু কলেজ প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে থাকে। কারণ কলেজের পরিচালন কমিটির একাংশও রনোজিৎ-এর রাজনৈতিক অভিভাবকদের সঙ্গে যুক্ত।
রনোজিৎ রণতুঙ্গা নিজেকে “কলেজের নেতা” নয়, “রাজনীতির ভবিষ্যৎ” ভাবে। তার মুখে সবসময় সস্তা আদর্শের বুলি — “যুব সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে”, “ছাত্রছাত্রীরা সমাজের স্তম্ভ” ইত্যাদি। অথচ বাস্তবতার মাটিতে সে একজন ভয়ংকর অপরাধী, যার মূল উদ্দেশ্য নিজের দখলদারি বজায় রাখা এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা।
নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীরা তাকে দেখলে ভয় পায়। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে তার দলে, ভবিষ্যতের সুযোগের আশায়। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয় চুপ থাকতে।
এই কলেজে একটা চাপা আতঙ্ক রয়েছে। প্রতিদিন কোনও না কোনও ঘটনা ঘটে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। সবাই জানে, কিছু বললে পরিণাম খারাপ হতে পারে।
আর এই ভয়, এই নিঃশব্দতা, এই অন্যায়ের স্বাভাবিকীকরণই রনোজিৎ রণতুঙ্গার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
পর্ব ৩ : ইশানীর আগমন: এক নতুন হাওয়া
এই দানবীয় পরিবেশেই একদিন পা রাখে ইশানী। প্রথম দিনই সে দেখে, কীভাবে এক ছাত্রীকে ‘ইউনিয়ন ফান্ড’-এর নামে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। পরদিন কলেজের এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনে, কীভাবে ক্লাসের বাইরে মেয়েদের ওপর কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়। ইশানীর চোখে রক্ত চেয়ে ওঠে।
সে বুঝে যায়, এই কলেজে শুধু পড়াশোনা নয় — এখানে লড়াই করতে হবে। নিজের স্বপ্নের, নিজের অস্তিত্বের জন্য — এবং অনেকের হয়ে একা দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সে ভীত নয়। গ্রামের সেই মেয়েটা, যে একদিন মাইক বন্ধ করেছিল গ্রাম প্রধানের সামনে, সে এখন অনেক বেশি দৃঢ়।
কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র একমাস হয়েছে। ইশানী একটু একটু করে বুঝে ফেলেছে, এই প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় পেশিশক্তি, আর ছাত্র ইউনিয়ন যেন কোনো শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং একটা রাজনৈতিক শিবির। এখানে শিক্ষার আলো নিভে আসছে ক্ষমতার ঘন ছায়ায়।
ইশানী দিনে দিনে বুঝতে পারছিল, শিক্ষকদের অধিকাংশই নিরুপায়। কেউ মুখ খোলে না রণজিৎ-এর বিরুদ্ধে। কারণ, রনোজিৎ রণতুঙ্গা শুধু একজন ছাত্রনেতা নয়, সে এক ভয়ংকর প্রতাপশালী চরিত্র, যার পেছনে সরকারদলীয় লোকজন, স্থানীয় এমএলএ, এমনকি থানার কিছু অফিসারেরও ছায়া রয়েছে।
কিন্তু এই অন্যায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা — এটা ইশানী মানতে পারে না।
সেই দিনটি ছিল 18 October — C. W. W. Kannangara-র জন্মজয়ন্তী। তাকে শ্রীলঙ্কার “Father of Free Education” বলা হয়। কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা একত্রিত হয়ে এই দিনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অডিটোরিয়ামের পাশে ছোট্ট মঞ্চে আবৃত্তি, গান, ও নাটকের প্রস্তুতি চলছিল। ইশানীও তাতে যুক্ত ছিল।
সকাল থেকেই পরিবেশ ছিল পবিত্র, সৃষ্টিশীল, স্নিগ্ধ। তবে শান্তির সেই ছায়ায় কালো অন্ধকার এসে পড়ে দুপুর নাগাদ। হঠাৎ করেই কলেজের ইউনিয়ন রুমের বাইরে বিশাল DJ Box বসানো হয়। কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ এসে জোরে জোরে বলিউডের হিন্দি আইটেম গান বাজাতে শুরু করে — “চিকনি চামেলি”, “মুন্নি বদনাম”। তার সঙ্গে চলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, নাচ, চিৎকার।
শুরুতে কেউ কিছু বলে না। শিক্ষকেরা মাথা নিচু করে অনুষ্ঠান চালাতে থাকেন। ছাত্রীদের চোখে আতঙ্ক। কিন্তু একমাত্র ইশানীর চোখে ছিল তীব্র রাগ।
সে আর থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়।
ইশানী সোজা চলে যায় ইউনিয়ন রুমের সামনে। রণজিৎ তখন নিজের গ্যাং নিয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় নাচছে, হাতে সিগারেট। গানের তালে তার শরীর দুলছে, আর মুখে কুরুচিকর মন্তব্য।
ইশানী গিয়ে স্পিকারের তার টানতে থাকে।
রণজিৎ থেমে যায়, কটমট করে তাকায়। “তুই আবার কে রে? ইভেন্টে সমস্যা?” — গলায় ব্যঙ্গ।
ইশানী বলে, “এটা সুস্থ এবং সভ্য সংস্কৃতির দিন। এই চটুল গান, অশ্লীলতা এখানে বরদাস্ত করা যায় না। এটা কলেজ, ডিস্কো নয়।”
গোটা ইউনিয়ন রুম থমকে যায়। কেউ এইভাবে মুখের ওপর কিছু বলেনি আগে।
রণজিৎ রাগে ফেটে পড়ে, “তোর সাহস তো দেখছি বেশ বেড়েছে। এত জ্ঞান আসে কোথা থেকে?”
ইশানী জবাব দেয়, “সত্যিকারের শিক্ষা থেকে। তুমি এসব বুঝবে না।”
এই কথায় রণজিৎ রণতুঙ্গা ও তার গ্যাং চেঁচাতে শুরু করে, কেউ কেউ ইশানীর দিকে অশ্লীল মন্তব্য ছোড়ে। ইশানীর গালে হাত তুলে আঘাত করতে যায় এক সদস্য, কিন্তু তখন কয়েকজন সাধারণ ছাত্র এগিয়ে এসে মাঝখানে দাঁড়ায়।
এক অদৃশ্য উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কলেজে। শিক্ষকেরা এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষমেশ কলেজ প্রশাসন বাধ্য হয় DJ বন্ধ করে দিতে, এবং অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায়।
সেই দিনের ঘটনার ভিডিও কেউ একজন মোবাইলে তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। “একটি মেয়ের একা প্রতিবাদ” — এই শিরোনামে ভিডিওটি ভাইরাল হয়।
কলেজের কিছু শিক্ষক গোপনে প্রশংসা করেন, কিন্তু সামনে কেউ কিছু বলেন না। ইশানীর বন্ধুরা ভীত — “রণজিৎ রণতুঙ্গা ছেড়ে দেবে না তোকে”।
ইশানী বলে, “আমার ভয় নেই। সত্যি বলতে গেলে যদি আঘাত আসে, সে আঘাতও মেনে নিতে হবে। কিন্তু চুপ থাকা মানে নিজের সত্ত্বা খুন করা।”
পরদিন রণজিতের লোকজন কলেজ দেয়ালে পোস্টার লাগায় —
“সংস্কৃতির নামে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ”
অভিযোগ করা হয়, ইশানী নাকি বিরোধী দলের হয়ে কাজ করছে। কিন্তু ইশানী জানে, সত্যের সঙ্গে লড়াই করলে মিথ্যার ঢেউ উঠবেই।
পর্ব ৪: নিঃসঙ্গ বিপ্লব ও অন্ধকারে হারানো আলোর রেখা
কলেজে তখন রক্তদান উৎসবের রঙিন ব্যস্ততা। দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারগুলোতে বড় অক্ষরে লেখা — “তোমার রক্তে বাঁচুক প্রাণ, রক্ত দান জীবনের দান।” ছাত্রছাত্রীরা উৎসাহে ফেটে পড়ছিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে রেজিস্ট্রেশনের লাইনে দাঁড়ানো, স্বেচ্ছাসেবক ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি, শিক্ষকদের উৎসাহ — সব মিলিয়ে যেন একটা উজ্জ্বল দিনের প্রতিচ্ছবি।
ইশানীও রক্ত দিয়েছিল। সে বিশ্বাস করত, মানবতার জন্য কিছু করা উচিত। কলেজের মত জায়গা থেকেই তো সচেতনতা শুরু হওয়া উচিত। তার মনে হয়েছিল, এই আয়োজন হয়তো সত্যিই কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচাবে।
কিন্তু উৎসব শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই একটা অদ্ভুত গুঞ্জন কানে আসতে থাকে। প্রথমে ছোট ছোট কানাঘুষো — “শুনেছিস? রক্ত নাকি কোথায় যেন বিক্রি হয়ে গেছে…” “রণজিৎ রণতুঙ্গা আর ওর গ্যাং নাকি কারও সঙ্গে মেডিকেল ডিল করছে।”
ইশানী বিশ্বাস করতে পারছিল না। এত বড় অপরাধ কেউ কলেজে বসে করে কীভাবে? কিন্তু যখন স্থানীয় এক ছোট কাগজে খবর বেরোয়, তখন গুজবটা আর গুজব থাকে না। “রক্তদান উৎসবের আড়ালে কালোবাজারি?” — এমনই শিরোনামে ছাপা হয় রিপোর্টটি।
ছবিতে দেখা যায়, রণজিত আর তার সঙ্গীরা একটা দামি রেস্টুরেন্টে বসে মদে চুমুক দিচ্ছে, চারধারে দামি খাবারের থালা, পাশে হোয়িস্কির বোতল, হাসিতে ভরপুর মুখ।
সেই মুহূর্তে ইশানীর শরীরে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। মাথায় কেবল একটাই কথা — এরা ছাত্র? এদের জন্যই কি বাবা তার জমি বিক্রি করে, টাকা ধার করে তাকে শহরের কলেজে পাঠিয়েছে? এই কি শিক্ষার জায়গা?
দুপুরবেলা। কলেজে তখন অনেক ভিড়। কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব। সবাই জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
ইশানী একাই এগিয়ে চলে ইউনিয়ন রুমের দিকে। তার চোখে আগুন, মুখ শক্ত। পায়ের শব্দ যেন কানে কানে চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে — কেউ থামাবে না আমাকে।
ইউনিয়ন রুমের সামনে তখন কয়েকজন ছেলে আড্ডায় ব্যস্ত। কেউ চিপস খাচ্ছে, কেউ মোবাইলে গেম খেলছে। ইশানীকে দেখে একজন ঠাট্টা করে বলে, “আরে, বিপ্লবী আসছে!”
ইশানী সে কথার জবাব না দিয়ে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
রণজিৎ রণতুঙ্গা সোফায় পা তুলে বসে আছে। ঠোঁটে সেই চেনা কুটিল হাসি। পাশেই তার সাঙ্গপাঙ্গেরা। ইশানী গর্জে ওঠে, “তোমরা যেটা করেছো, সেটা শুধু অপরাধ নয় — সেটা পাপ। মানুষের প্রাণের রক্ত বিক্রি করে তোমরা পার্টি করেছো? তোমরা নিজেদের শিক্ষার্থী বলো?”
রণজিত হেসে ওঠে। “তুই জানিস না, কার সঙ্গে কথা বলছিস। পুলিশ? মিডিয়া? সবাই আমাদের পকেটে।”
ইশানীর গলা নড়ে না। ঠান্ডা স্বরে বলে, “একদিন তোমাদের ক্ষমতা শেষ হবে। সেদিন তোমরা পালাবার পথ খুঁজে পাবে না।”
এই কথা শোনার পর ওরা যেন ছায়ার মতো একে একে উঠে দাঁড়ায়। রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ওকে। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। একজন ওর চুল ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। আরেকজন দরজায় পাহারায় দাঁড়ায়।
ইশানী চিৎকার করে না। সে কেবল চোখে চোখ রেখে বলে, “তোমরা আমাকে ভাঙতে পারো, কিন্তু থামাতে পারবে না।”
তারপর যা ঘটে — তা সময়কে ঠেলে ধাক্কা দেওয়া এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস।
সকলে মিলে চড়াও হয় ইশানীর উপর। এক এক করে ধর্ষণ করে তাকে। মাথার কাছে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে একজন। শব্দ করলেই মাথায় ঘা দিয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ইশানীর চোখের সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
পর্ব ৫: আগুনে স্পর্শ, প্রতিবাদের বিস্ফোরণ
ইশানীর চোখ খুলল একধরনের ভারি অন্ধকার থেকে। মাথাটা ঘোরাচ্ছে, শরীরের প্রতিটি কোষ যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। চারপাশটা ফাঁকা, নির্জন, যেন এক ভাঙা ঘরের ভেতরে পড়ে আছে সে — একা, নীরব, ক্ষতবিক্ষত। কিছুক্ষণের জন্য নিজের শরীরটা যেন আর নিজের মনে হয় না। শরীরের কিছু অংশে পোড়া ব্যথা, কিছু অংশ নিস্তেজ। কাপড় ছেঁড়া, গায়ের উপর আঁচড় আর চিহ্ন, এবং ভিতরে… ভিতরে যা রয়ে গেছে, তার কোনো ভাষা নেই।
চোখটা একটু বেশি খুলে চারপাশ দেখে — এটা ইউনিয়ন রুম। সেই ঘর, যেখানে কাল সে ন্যায় চাইতে গিয়েছিল, আর আজ নিজের আত্মসম্মান হারিয়ে পড়ে আছে। পায়ের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেছে এক পুরনো প্লাস্টিক বোতল, সিলিং ফ্যানে ধীরে ধীরে ঘুরছে একটা ছেঁড়া ঝুল। দেওয়ালে রণজিতের হাসিমুখের ছবি, যেটা কাল পর্যন্ত এই কলেজে ক্ষমতার প্রতীক ছিল — আজ যেন সেটাই তার আততায়ীর মুখ।
কোনোমতে নিজেকে টেনে তোলে ইশানী। হাঁটতে গিয়ে টাল খায়, দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। রক্ত জমাট বাঁধা ঠোঁটের ফাঁকে সে নিজেকে বলে, “এখন থামলে চলবে না… এখন নয়।”
রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে আলো ফুটেছে, পাখিরা ডাকছে, কিন্তু সব যেন নিষ্ঠুর ঠেকে — যেন প্রকৃতিও তার পাশে নেই আজ। কেউ থামায় না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। সবার চোখে শুধু ভয়, আর একটা অপমানিত কৌতূহল।
ইশানী সোজা হাঁটতে থাকে। পা চলছে, যদিও গায়ে শক্তি নেই। একটা রিকশাও থামে না। তারপরেও সে থেমে থাকে না। এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে পৌঁছে যায় থানায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল প্রথমে চোখ বড় করে তাকায়। এই অবস্থায় মেয়েটা এসেছে কেন?
অফিসার তাকে বসায়। ইশানী গলায় শক্তি এনে বলে, “আমি কলেজে পড়ি। গতকাল আমাকে ইউনিয়ন রুমে রণজিৎ রণতুঙ্গা আর তার বন্ধুরা… তারা…” গলা বুজে আসে, কিন্তু চোখে কান্না নয় — সেখানে আগুন।
পুলিশ প্রথমে চুপ করে থাকে। তারা জানে রণজিৎ কে। তার বাবার প্রভাব, রাজনৈতিক ব্যাকআপ, পেছনে রাজ্যের এক প্রভাবশালী নেতা — এই মেয়ে এসব জানে? তা সত্ত্বেও এসেছে?
ইশানী বলে, “আমি লিখিত অভিযোগ দেব। FIR করুন। আমি পিছু হটব না।”
একটু দেরি হলেও FIR নেওয়া হয়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানো হয়। মেডিকেল চেকআপে যা দেখা যায়, তা ভয়ঙ্কর। ডাক্তারের চোখে অস্বস্তি, নার্স মুখ ফিরিয়ে থাকে। রিপোর্টে স্পষ্ট — শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন, যৌন নির্যাতনের প্রমাণ।
সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যেন দাবানলের মতো। এক সাংবাদিক ঘটনাস্থলে এসে লাইভ করে — “কলেজের ইউনিয়ন রুমে ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ। রাজ্য কাঁপছে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসে হাজার হাজার পোস্ট — #JusticeForIshaani #StopCampusCrime। রাজনীতির মঞ্চ কাঁপে, বিরোধী দল সমাবেশ ডাকে। শ্রীলঙ্কার সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেন — “অপরাধীদের রং দেখা হবে না। কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
পুলিশ তড়িঘড়ি করে রণজিৎ রণতুঙ্গা ও তার চার সঙ্গীকে গ্রেফতার করে। ক্যামেরার সামনে মুখ ঢাকে তারা, কেউ চিৎকার করে, “আমরা নির্দোষ!”
ইশানী তখন হাসপাতালের বিছানায়। তার চোখে চাপা জেদ। একটা সাংবাদিক প্রশ্ন করে, “আপনি ভয় পাচ্ছেন না?” ইশানীর গলা শুকনো, তবুও জবাব দেয়, “ভয় পাওয়ার সময় ছিল না আমার। যারা চুপ করে থাকে, তারাও অপরাধী হয়। আমি চুপ করিনি।”
তার ছবি, তার কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি সংবাদপত্রে। কেউ তাকে ‘বিপ্লবী’ বলে, কেউ বলে ‘আত্মসম্মানের প্রতীক’।
কিন্তু ইশানী জানে — এই গল্পের শেষ হয়নি। আদালত, তদন্ত, রাজনৈতিক চাপ — অনেক পথ এখনও বাকি। তবু এক পা সে এগিয়ে দিয়েছে। একা, অথচ দৃঢ়। কারণ সত্য যতই চাপা পড়ুক, একদিন সে আলো ফোটাবেই।
পর্ব ৬: মুখোশের ভাঙন ও আত্মার বিদ্রোহ
শ্রীলঙ্কার সরকার অস্বস্তিতে। দিনের পর দিন যেভাবে টেলিভিশনের পর্দায়, সংবাদপত্রের শিরোনামে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে রণজিৎ রণতুঙ্গা আর তার দলবলের কুকর্ম, তাতে যেন গোটা শাসকদলটাই প্রশ্নের মুখে। মানুষের চোখে মুখে একটাই কথা— “সরকার কী করছে?”
সাধারণ মানুষ, শিক্ষক সমাজ, বুদ্ধিজীবীরা মুখ খুলছে। মিছিলের প্ল্যাকার্ডে লেখা, “ইশানীরা যখন নির্যাতিত, সরকার তখন নীরব!” কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে, “ক্ষমতা কি ধর্ষকদের ঢাল হয়ে দাঁড়াবে?”
এই অবস্থায় শাসকদলের সুপ্রিম লিডার— যিনি কেবল রাজ্যের নয়, দেশের মধ্যেও রাজনৈতিক কুশলতায় এক চতুর খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত, তিনি তড়িঘড়ি মিটিং ডাকলেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “এই দুর্নামের ছায়া দল থেকে সরাতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব।”
তার ডানহাত দুই মুখপাত্র— রুশান পেরেরা ও অভয় বন্দারনায়েক । দু’জনেই বাগ্মী, চাতুর্যে ভরপুর, মিডিয়ায় রীতিমতো চেনা মুখ। নেতার আদেশের পর তারা যেন নিজেদের রাজনৈতিক অস্ত্রগুলি আরও শান দিতে শুরু করল।
“রণজিৎ রণতুঙ্গার মত ছেলেরা আমাদের দলের সম্পদ। ও যদি জেলে যায়, কলেজে কলেজে সব ছাত্র-নেতারা ভয় পেয়ে কাজ বন্ধ করে দেব। সরকার দুর্বল হয়ে যাবে। তা হতে দেওয়া যাবে না।”
“মানুষ অল্পদিনেই ভুলে যায়। আমাদের কাজ হলো নিয়ন্ত্রণে রাখা। আজকে এটা ইস্যু, কাল অন্য ইস্যু এলেই এটা চাপা পড়ে যাবে।”
এভাবে কথোপকথনের মাধ্যমে তারা তৈরি করল সেই ষড়যন্ত্রের গল্প — যেখানে ইশানী ‘রাজনৈতিক চক্রান্তের হাতিয়ার’ আর রণজিৎ রণতুঙ্গা ‘সরল ছেলে, যাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
পরদিন সন্ধ্যায় দেশের এক নামকরা টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ প্রাইমটাইম শো-তে হাজির হলেন সরকারের মুখপাত্র রুশান পেরেরা ও অভয় বন্দারনায়েক। চারপাশে ক্যামেরা, সামনে আলো, উপস্থাপক উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এটা দেশের জন্য লজ্জার সময়। একজন কলেজ ছাত্রী বলছে, সে গণধর্ষণের শিকার। আপনারা কি বলতে চান, সে মিথ্যে বলছে?”
রুশান পেরেরা চোখ টিপে বললেন, “আমরা শুধু বলছি, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কাউকে দোষী বলাটা অন্যায়। রণজিৎ রণতুঙ্গা একজন ছাত্রনেতা, বরাবর সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত। এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
অভয় বন্দারনায়েক যোগ করলেন, “এটা সরকারের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত। আগের সরকারগুলোতে আরও কত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে, তখন কেউ এত চিৎকার করেনি। এখন আমাদের সরকার এগিয়ে যাওয়ায় অনেকেই গাত্রদাহে ভুগছে।”
উপস্থাপক প্রশ্ন করলেন, “ইশানীর মেডিকেল রিপোর্ট আছে, ভিডিও ফুটেজ, সামাজিক উত্তালতা — এগুলো কি সব সাজানো?”
অভয় বন্দারনায়েক হেসে বললেন, “ভিডিও এডিট করা যায়, রিপোর্ট বানানো যায়। আমরা চাই বিচার হোক, কিন্তু আগে সত্যটা সামনে আসুক।”
লাইভ শো-তে এই বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারিত হলো, কোটি কোটি মানুষ দেখল। কেউ ক্ষুব্ধ হলো, কেউ চুপ। কিন্তু সবকিছুর ভিতরে কোথাও যেন একটা ভরসার দেয়াল ভাঙতে শুরু করল।
সেই রাতেই, দুজনেই বাড়ি ফিরলেন। মিডিয়ার সামনে তারা চওড়া হাসি দিয়ে বলল, “দেখছেন তো, সরকারের মুখ আমরা বাঁচিয়ে দিলাম।” কিন্তু সেই হাসি অনেকক্ষণ স্থায়ী হলো না।
রুশান পেরেরা বাড়িতে ঢুকতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার স্ত্রী কাঁদছে, বাড়ি নিস্তব্ধ, মেয়ের ঘরের দরজা খোলা— ভিতরে বিছানার উপর শুয়ে রয়েছে তার একমাত্র কন্যা নিশাদিকা, নিথর। শরীর ঠান্ডা। হাতে ধরা একটা ছোট চিরকুট।
অভয় বন্দারনায়েকের ফ্ল্যাটেও একই দৃশ্য। তাঁর মেয়ে, দিলুশি, ছাদের রেলিং থেকে লাফ দিয়েছে। পুলিশ এসে চিঠি উদ্ধার করেছে তার ব্যাগ থেকে।
দুই চিঠিই প্রায় একই ভাষায় লেখা।
“বাবা, আজ টিভিতে তোমাকে দেখলাম। একজন ধর্ষকের হয়ে তুমি গলা ফাটালে। আমি জানি রণজিৎ কে, আমি ঐ কলেজেই পড়ি। ইশানীর জায়গায় আমি হতে পারতাম। হয়ত তুমি তখনও বলতে, আমি ফাঁসিয়েছি। আমি তোমার মেয়ে — এই সত্যটাই আজ আমাকে ধ্বংস করছে। তুমি যা করেছো, তা শুধু ইশানীর প্রতি অন্যায় নয়, তা আমার অস্তিত্বের প্রতিও আঘাত। আমি আর থাকতে পারছি না। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছি না। আমি চললাম। ক্ষমা করে দিও যদি পারো। কিন্তু এই শহর, এই রাজ্য, এই সমাজ — এটা সৎ মানুষের জায়গা নয়। এটা দৈত্য, অসুর, ভণ্ডদের শহর। আমি আর পারছি না থাকতে।”
রুশান পেরেরা ভেঙে পড়ে স্ত্রীর পায়ের কাছে, গলা ধরে আসে। অভয় বন্দারনায়েক নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে, যেন তার বুকের ভেতর থেকে কে যেন কিছু ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। দুই রাজনৈতিক নেতা, যারা একদিন বড় বড় সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, আজ তারা দুজন দাঁড়িয়ে আছেন পিতৃত্ব আর পাপবোধের চূড়ান্ত সীমানায়।
ওরা ভুলে গিয়েছিল, মিথ্যার পেছনে দাঁড়াতে গিয়ে কখনও কখনও সবচেয়ে বড় শাস্তি দেয় নিজস্ব আত্মা, নিজের সন্তান।
পর্ব ৭: বিচার আর বিস্মৃতির মাঝখানে
ইশানী এখন শহরের হাসপাতালের একটা সাধারণ কেবিনে। শরীর সেরে উঠছে ধীরে ধীরে, কিন্তু তার মন এখনো রক্তাক্ত। ঘুম আসে না। রাতভর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রাস্তায় হর্ন শোনা যায়, কখনো অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যায়, আবার কখনো চুপচাপ পড়ে থাকে চারপাশ।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ইশানী নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে— “বিচার কি সত্যিই হবে?”
ওর দেওয়া এফআইআরের ভিত্তিতে পুলিশ চার্জশিট তৈরি করছে, শুনানি শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। সংবাদমাধ্যম ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। যেসব চ্যানেল আগুনের মতো প্রতিবাদ করছিল, এখন তারা নতুন কোনো সিনেমার রিভিউ, ক্রিকেটের হাইলাইট বা রাজনীতির অন্য গন্ধে ব্যস্ত।
কয়েকজন সাংবাদিক ফোন করে বলেছে, “আপাতত নিউজ ভ্যালু কমে গেছে। কিন্তু আপনাকে ভুলে যাইনি।”
ইশানী হেসেছে। একরকম করুণ হাসি।
বাইরে রাজনীতি চলছে তার নিজের নিয়মে। ক্ষমতার খেলা আর চক্রান্ত — সেই একই পথে হাঁটছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই শুরু হয়েছে ভাতা, উপহার, উন্নয়নের ফ্লেক্স আর দান-খয়রাতির ঝড়। যারা টাকা নিচ্ছে, তাদের ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ঢুকছে; যারা নিচ্ছে না, তাদের মনে ভয় ঢুকছে — “বাচ্চাটাকে স্কুলে পাঠাবো তো? যদি কেউ কিছু করে বসে?”
একদিন ইশানীর কানে আসে— রণজিৎ রণতুঙ্গা আর তার গ্যাং-এর কয়েকজন নাকি জামিন পেয়ে গেছে। প্রমাণের অভাবে। কিছু সাক্ষী বেপাত্তা, কিছু ঘুষ খেয়েছে। বাকিরা ভয় পেয়েছে।
ইশানী জানে, এটাই নিয়ম এখানে। ভালো মানুষ একা হয়ে যায়। যারা জেগে থাকে, তারা পুড়ে যায়। যারা প্রতিবাদ করে, তাদেরই মুখ বন্ধ করা হয়। তবু ইশানী জানে, সে থামবে না। হয়তো একদিন সত্যিই দুনিয়া বদলাবে না। হয়তো তার গল্প চাপা পড়ে যাবে পরবর্তী আরও অন্যান্য কেলেঙ্কারির নিচে। কিন্তু তবু কোথাও কেউ একজন— হয়তো কোনো অচেনা ছোট্ট মেয়েটি— তাকে মনে রাখবে। মনে রাখবে, একটা মেয়ে একদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়েছিল।
আর সেই স্মৃতি থেকেই হয়তো আবার জন্ম নেবে নতুন কোনো ইশানী। নতুন কোনো আগুন।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।