রেলস্টেশন থেকে মিনিট দশেক হাঁটলে একটা ছোট পাকা রাস্তা ধরে শহরের ভেতরে ঢুকতে হয়। সেখানেই এক কোনায়, বটগাছের নিচে বসে আছে ‘বাবুলের চায়ের দোকান’। নামটা খুব সাধারণ হলেও দোকানটা একটু অদ্ভুত। কারণ এই দোকানে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় আসে চারজন অপরিচিত মানুষ—কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না, শুধু বসে চা খায়, আর একটা খাতায় কিছু একটা লেখে।
বাবুল শুরুতে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ছয়মাস ধরে রোজ একই সময়, একই রুটিনে এদের আসা, বসা, খাতা লেখা—সবকিছুই এত নিখুঁত যে, দোকানপাটে বসা বাকি ক্রেতারাও বিষয়টা লক্ষ্য করতে শুরু করেছিল।
চারজনের মধ্যে একজন সবসময় কালো পাঞ্জাবি পরে, চুল পেছনে আঁচড়া দেওয়া; আরেকজন চশমা পরে, মোটা খাতার মতো কিছু হাতে নিয়ে আসে; তৃতীয়জন নীরব—চা হাতে নিয়েই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে; আর শেষ জন বেশ হাসিখুশি, কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।
বাবুলের দোকানে একটি পুরনো কাঠের আলমারিতে রাখা থাকে নোটবই, কাস্টমারদের বাকি লেখার খাতা, ইত্যাদি। চারজন লোক খাতা লেখে, সেটি দোকানের ঠিক ওই আলমারিতেই জমা করে রেখে যায়। প্রথমে বাবুল ভেবেছিল এটা হয়তো লেখকদের কোনো গোপন মিটিং বা গল্প লেখার ক্লাব। কিন্তু কৌতূহলটা তার জোরে চেপে বসতে থাকে দিনদিন।
একদিন সন্ধ্যা ছয়টার পরে যখন দোকানে ভিড় নেই, বাবুল সাহস করে আলমারি খুলে খাতাটা বের করল। খাতার উপর লেখা — “গোপনীয়: পর্যবেক্ষণ-ডেটা ৪৯৭/পূর্বাঞ্চল”।
সে প্রথম পাতা খুলে দেখে লেখা—
“১৭ মার্চ: লক্ষ্যবস্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে। সন্দেহজনক গতিবিধি। সন্দেহভাজন দ্বিতীয় ব্যক্তি ‘রামেশ্বরী হোটেল’-এ প্রবেশ করেছে। তথ্য উপস্থাপন: ক্রমিক ৩৪”
বাবুলের চোখ কপালে! এ তো গোয়েন্দাদের রিপোর্টের মতো কিছু! পরের পাতাগুলিতে আরও বিস্তারিত লেখা— সময়, তারিখ, ছবি আঁকার মতো চিহ্ন, কিছু সাংকেতিক চিহ্ন, এমনকি কিছু নাম ও ফোন নম্বর!
একটা পাতায় সে নিজের দোকানের কথাও পড়ে—
“লক্ষ্যবস্তু প্রতিদিন বাবুলের চায়ের দোকানে ৫টা ২০-৫টা ৪০ পর্যন্ত অবস্থান করে। সম্ভাব্য যোগাযোগ বিন্দু।”
বাবুলের মাথা ঘুরে যায়। সে বুঝতে পারে, সে যা এতদিন অবহেলায় দেখেছে, সেটার মধ্যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।
সে খাতা বন্ধ করে রেখে দেয়। কিন্তু তারপর থেকেই তার ওপর যেন কারও নজর।
একদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তার কোণ থেকে এক অজানা কণ্ঠস্বর তাকে থামায়, “খাতার ভেতরটা কেমন লাগল বাবুলদা?”
সে পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখে না। আরেকদিন দোকানে এক নতুন ছেলে এসে জিজ্ঞেস করে, “আপনার দোকানে কি খাতা রাখেন গ্রাহকদের নামে?” বাবুল মাথা নাড়তেই ছেলেটি জোরে হাসে, “ভুলে যান! যা দেখেছেন, ভুলে যান!”— বলেই চলে যায়।
এরপর, তার মোবাইলে অচেনা নম্বর থেকে কল আসে রাতে—
“আপনি যদি খাতার কথা কাউকে বলেন, তাহলে আপনি, আপনার দোকান, আর আপনার পরিবার কেউ নিরাপদ থাকবে না।”
ভয়ে দিশেহারা বাবুল পরদিন থেকে খাতা আর ছুঁয়েও দেখে না। চারজন লোক যথারীতি আসে, চা খায়, লিখে যায়, চলে যায়। দোকানে যেন এক অদৃশ্য আতঙ্ক ছায়ার মতো ঘোরে।
কিন্তু কিছুদিন পর একদিন, চারজনের কেউই আসে না। বিকেল পেরিয়ে যায়, সন্ধ্যা নামে, রাত হয়—কিন্তু কেউ আসে না। বাবুল অবাক হয়, শঙ্কিত হয়, কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না।
তবে সেই রাতে তার দোকানের দরজার নিচ দিয়ে একটি খাম গড়িয়ে পড়ে। খামটা খুলে দেখে ভিতরে লেখা—
“পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত। ধন্যবাদ, আপনার নিরব সহযোগিতার জন্য।”
আরেকটি ছোট চিরকুটে লেখা—
“বাঁচতে চাইলে সব ভুলে যান। নতুন খাতা কেউ খুলবে না।”
এরপর থেকে বাবুল চুপচাপ নিজের কাজ করে যায়। দোকানে আগের মতোই লোক আসে, গল্প করে, চা খায়। কিন্তু সেই খাতাটা আর কেউ খোঁজে না, আর বাবুল নিজেও আর কখনও সেই আলমারির দিকে চোখ তুলে তাকায় না।
কারণ সে এখন জানে, কিছু কৌতূহল জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।
আর কিছু ফাইলের ভেতরে শুধু লেখা নয়—লুকিয়ে থাকে জীবন-মৃত্যুর মাঝের সীমানা।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।