পর্ব ১: অদৃশ্য বোতাম
তৃষা সদ্য কলেজ পাশ করেছে। ইকোনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেয়েটির ভাগ্য যেন এক লাফে উজ্জ্বল হয়ে উঠল—বড় শহরের বহুজাতিক সংস্থা ইনফিনিটিক কর্পোরেশন তাকে নিয়োগ করল হেড অফিসে। গ্রাম থেকে আসা তৃষার জন্য এ এক বিরাট সাফল্য, কিন্তু শহুরে জীবনের নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ তার কাছে যেন অচেনা ভাষার মতো।
প্রথম কয়েকদিন সে অনেকটাই চুপচাপ ছিল। অফিসের লোকেরা ব্যস্ত, দ্রুত কথা বলে, হাই-হ্যালো ছাড়া যেন তাদের আর কিছু বলার নেই। তবে ক’দিন পর কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় — মধু, শাওন, ইশান আর রোহিত। এদের মধ্যে শাওন আর ইশান একটু দুষ্টু স্বভাবের, মধু খুব মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, আর রোহিত সবসময় বইপত্র আর মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকে।
একদিন অফিস শেষে এক ক্যাফেতে সবাই মিলে শাওনের জন্মদিন উদযাপন করতে যায়। হাসি-মজা, গান, কেক, সেলফি — সবই চলছিল। সেই সময় হঠাৎ করে কথায় উঠে আসে বিল্ডিং-এর গঠন নিয়ে আলোচনা। রোহিত হঠাৎ বলে ওঠে —
“আচ্ছা, তোমরা খেয়াল করেছ? আমাদের অফিস বিল্ডিং-এর লিফটে ১৩ নম্বর বাটন নেই!”
তৃষা কপাল কুঁচকে বলে, “মানে? তেরো তো বারো আর চোদ্দর মাঝে পড়ে, সেই তলা গেল কোথায়?”
মধু তখন মুখটা গম্ভীর করে বলে, “ওটা বাদ দেওয়া হয়েছে। কেউ বলে, তেরো নম্বর সংখ্যা নাকি অপয়া। অনেকে আবার বলে, ওই ফ্লোরে আত্মা আছে।”
ইশান হেসে ফেলে, “আরে ধুর! এসব হুজুগ! ওটা এখনও রেডি হয় নি, তাই তালা দেওয়া আছে।”
শাওন হঠাৎ গলা নামিয়ে বলে, “একবার শুনেছিলাম, বহু বছর আগে এখানে এক কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার দুর্ঘটনায় মারা গেছিল। তারপর থেকে নাকি রাতে আওয়াজ শোনা যায় — হাতুড়ির ঠকঠকানি, কাঁচের চিঁচিঁ আওয়াজ, কারো ফিসফাস। কেউ কেউ আবার খালি চোখেও কাউকে দেখতে পেয়েছে।”
কথাগুলো তৃষার মনে গেঁথে যায়।
পরের দিনগুলো স্বাভাবিকভাবেই কেটে যায়। তৃষা ধীরে ধীরে কাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু মাথার এক কোণে সেই ১৩ তলার কথাটি ঘুরতে থাকে। অফিসের লিফটে যখনই ওঠে, চোখ চলে যায় বোতামগুলোর দিকে। ১২-এর পর সরাসরি ১৪ — কিন্তু মাঝখানে যে ১৩ নম্বর বোতামের জায়গা, সেটা ভাঙা। সেখানে কিছু নেই।
একদিন অফিসে অনেক কাজ ছিল। ম্যানেজার হঠাৎই কিছু অতিরিক্ত রিপোর্ট চায়। তৃষা মাথা নিচু করে, ক্লান্ত দেহে কাজ করে যায়। চারিদিকে অফিস ফাঁকা হয়ে গেছে, কেবল দু-একজন সিকিউরিটি আর হাউজকিপিং রয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৯টা ৫৭।
সব কাজ শেষ করে তৃষা লিফটের দিকে এগোয়। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন কেউ নিঃশ্বাসও নিচ্ছে না। লিফট এসে যায়। সে ভেতরে ঢোকে। তাড়াহুড়ো আর ক্লান্তিতে আঙুল পড়ে এক চিরঅদৃশ্য বোতামে — ১৩।
প্রথমে সে টেরই পায় না। কিন্তু লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে, বোতামগুলোর মধ্যে একটাতে আলোকিত লেখা দেখে সে চমকে ওঠে — ১৩।
“কীভাবে সম্ভব?”— তার বুকের মধ্যে ঠকঠক শব্দ ওঠে।
লিফট ধীরে ধীরে নামতে থাকে। ১৭…১৬…১৫…১৪…এরপর—
ডিং!
দরজা খুলে যায়।
তৃষা হতবাক। ১৩ তলা সত্যিই আছে! বাইরে আধা-অন্ধকার করিডোর, দেওয়ালের রং ছোপ ছোপ হয়ে গেছে, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কাঠ, প্ল্যাস্টার, লোহার রড। কোথাও একটা জানালা খোলা, বাইরে শহরের হালকা আলো এসে পড়েছে এই ফ্লোরে।
তৃষার কৌতুহল চরমে। সে ধীরে ধীরে পা বাড়ায়, বেরিয়ে আসে লিফট থেকে। কেউ নেই চারপাশে। কোথাও একটা জানালা কেঁপে ওঠে। বাতাসে শুকনো পাতার খসখস শব্দ।
একদিকে একটা ঘরের দরজা — ভাঙা, রং খসে পড়েছে। দরজার ওপর একটা ছোট প্লেট, লেখা নেই কিছু। কিন্তু দরজায় বড় একটা লোহার তালা ঝুলছে। তালার গায়ে স্পষ্টভাবে মোটা অক্ষরে কিছু আঁচড় কাটা, যেন কেউ নখ দিয়ে লিখেছে —“আমরা ছিলাম …”
তৃষা হাত বাড়িয়ে তালাটা ছুঁতেই হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ বয়ে যায় শরীর দিয়ে। তালা হালকা কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে কক্ষের ভেতর থেকে আসে এক অদ্ভুত আওয়াজ — গোঙানির মতো, যেন কেউ বলছে, “ফিরে যা… ফিরিয়ে দে…”
তৃষা ভয় পেয়ে পেছন ফিরে পালাতে চায়, কিন্তু পা যেন আটকে গেছে মেঝেতে। কক্ষের দরজার ফাঁক দিয়ে এক ছায়া বেরিয়ে আসে — অস্পষ্ট, কিন্তু তৃষার চোখ বুঝতে পারে, ওটা মানুষ নয়।
এক মুহূর্তে সব আলো নিভে যায়। তার চোখ অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে সে অনুভব করে, একটা বরফ ঠান্ডা হাত তার মাথায় ছুঁয়ে যায়।
তৃষা জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোয় না। হঠাৎ সব কিছু ঘুরতে শুরু করে। তার মনে হয় মেঝে দুলছে, দেয়াল ঘুরছে, কানে কে যেন চিৎকার করছে, দূর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদের ধ্বনি।
তারপর একটা অন্ধকার ঢেউ এসে ঢেকে দেয় সব। তৃষা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
পর্ব ২: প্রত্যাবর্তন
তৃষা জ্ঞান ফিরে পায় । কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। চোখ ধীরে ধীরে খুলে যায়। তার সামনের দৃশ্যটা অস্পষ্ট, যেন কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখের পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠে একসময় সে বোঝে, সে পড়ে আছে সিঁড়ির ধাপের এক পাশে — নিচের ফ্লোরে।
তার কপাল ভিজে, ঠোঁট শুকিয়ে আছে। পাশ থেকে কেউ বলে ওঠে, “মা… মা গো… জলে মুখটা একটু ধুয়ে নাও তো!”
তৃষার চোখ পুরোপুরি খোলে। এক বয়স্ক সাফাইকর্মী — চোখে মোটা চশমা, গায়ে ময়লা জামা।
“তোমার নাম তৃষা তো? অফিসের আইডি দেখে বুঝলাম।”
তৃষা কাঁপা গলায় বলে, “হ্যাঁ… আমি… আমি কি নিচে পড়ে গেছিলাম?”
সাফাইকর্মী মাথা হেলায়। “তোমায় আজ ভোররাতে সিঁড়িতে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছি। অন্য কেউ দেখলে চমকে যেত। অফিসে তো কেউ থাকে না এত রাতে।”
তৃষা ধীরে ধীরে উঠে বসে। “আপনার নাম?”
“অজিত,” বৃদ্ধ হেসে বলে, “এই অফিসে কাজ করি তিরিশ বছর ধরে।”
তৃষার মাথায় মুহূর্তেই সেই ঘটনা ভেসে ওঠে — ১৩ তলা, তালাবদ্ধ ঘর, ছায়া, ঠান্ডা স্পর্শ, তার পর অন্ধকার। সে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ থাকে, তারপর ধীরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন ১৩ তলায় কী আছে?”
অজিতের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। চশমাটা চোখে গুঁজে নিয়ে সে কড়া গলায় বলে, “ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। ওখানে আর যেও না মা। যা দেখেছো, ভুলে যাও। আর কাউকে কিছু বলবে না, বুঝলে?”
তৃষা একটু অবাক হয়, কিন্তু গলায় ভয় ঢুকে পড়েছে। সে কেবল হালকা মাথা নাড়ে।
এরপর অফিসে সে স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে। কাউকে কিছু জানায় না। শাওন, ইশান, রোহিত কেউ কিছু বুঝতেও পারে না। কিন্তু রাত বাড়লেই যেন তৃষার ভেতরে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি হয়। যেন কেউ ডাকছে তাকে। এক অজানা টানে সে আবার উঠে দাঁড়ায় লিফটের সামনে। ধীরে ধীরে রাতগুলোতে সে আবার ১৩ তলায় যেতে শুরু করে।
প্রতিবারই লিফট চুপচাপ এসে দাঁড়ায় সেই তলায়। দরজা খুলে যায়। করিডোরে ঢুকলেই একটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যেন পুরনো কবর থেকে উঠে আসা বাতাস তাকে ঢেকে ফেলে।
একদিন ফ্লোরটা আর আগের মতো ফাঁকা বলে মনে হয় না। দেয়ালের পাশে পড়ে থাকা পুরনো ব্যাগ, কাঠের চেয়ার, একটা নষ্ট ঘড়ি — সব কিছুতেই জীবনের স্পর্শ। একটা ঘরের কোণে পড়ে থাকা জামা, ছেঁড়া পুতুল, ছোট ছোট পাত্র — সব কিছুই যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে তৃষার চোখে।
সে মেঝেতে বসে থাকা অবস্থায় একটা পুতুল হাতে নেয় — ময়লা, রঙচটা। কিন্তু চোখের পলকে পুতুলটা যেন কেঁপে ওঠে। সেই মুহূর্তে তার মনে হয় — এই পুতুলটা সে আগে কোথাও দেখেছে। খুব ছোটবেলায়। কার ঘরে যেন। তার নিজের স্মৃতির গভীর থেকে ভেসে ওঠে এক ফ্ল্যাশব্যাক।
একটা ছোট্ট মেয়ে, লাল জামা পরে, এই পুতুলটা আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। পাশে একটা মহিলা —মা? না, তার মুখটা অস্পষ্ট। আবার একটা দৃশ্য — তালাবদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক পুরুষ, খুব রাগান্বিত। ছোট্ট মেয়েটা কাঁদছে, দরজার ওপার থেকে যেন কেউ কড়া নাড়ছে। সেই শব্দে আবার ভেসে যায় তৃষা।
সে চমকে ওঠে। চোখের সামনে আবার সব অন্ধকার। পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কান ঘেঁষে হালকা ফিসফাস —“ফিরে এসো… ফিরে এসো…”
তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরদিন আবার সেই অজিতই তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। সে ধীরে ধীরে তুলে নেয়, জল খাওয়ায়, আর চুপচাপ বসে থাকে।
তৃষা এবার আর চুপ করে থাকতে পারে না। সে বলে, “অজিত কাকা… আমাকে বলুন, কি আছে ঐ ঘরে? আমি আগেও এসেছি এখানে। আমি এসব জিনিস চিনতে পারছি। আমার মনে হয়… এই ঘর আমি কোনওভাবে জানি। আমি স্বপ্নেও দেখতে পাচ্ছি এখানে মানুষ ছিল… তাদের জীবন ছিল… ওরা কারা?”
অজিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “বেশ, তুমি যখন এতটা জানতে চাইছ, তখন আর লুকিয়ে লাভ নেই। কিন্তু তুমি যা কিছু শুনবে তার ব্যাখ্যা হয় না, তুমি কি সেসব বিশ্বাস করবে ??”
তৃষা মুচকি হেসে বলে, “আমি নিজেই তো আমার দেখা জিনিসের ব্যাখ্যা পাচ্ছি না! আপনি বলুন।”
অজিত কিছু বলে। তৃষা সব শোনে। এরপর তৃষা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ঐ ঘরের তালা আমাকে ভাঙতেই হবে, আমি জানতে চাই ঐ ঘরের ভিতরে কি আছে। আমার মনে হয় কেউ যেন আমাকে ডাকছে। আমাকে রহস্যের সন্ধান করতেই হবে।“
তৃষার কথায় কিছু একটা ঘোর ছিল। তার সাহস প্রবাহিত হয়ে অজিতের মনেও সাহস সঞ্চয় করে। অজিত বলে, “ঠিক আছে। আমি তোমাকে ঐ ঘরের তালা ভাঙতে সাহায্য করব। কিন্তু মনে রেখো — যা দেখবে, তার জন্য নিজেকেই তৈরি রাখতে হবে। অনেক কিছু আছে সেখানে, যা জাগতিক নয়। অতীত, যা মুছে দেওয়া হয়েছিল, আবার জেগে উঠবে…।”
তৃষার চোখে কৌতূহল আর ভয় একসাথে খেলা করে। তার ঠোঁট ফাঁক হয়, ধীরে ধীরে বলে, “আমি তৈরি…।”
পর্ব ৩: চাপা পড়া ইতিহাস
সময়টা আজ থেকে পনেরো বছর আগে।
শহরের অন্যতম বড় নির্মাণ প্রকল্প। ২১ জন শ্রমিক একসাথে কাজ করছে। তাদের কাজ করার শব্দ, হাসি ঠাট্টার শব্দ। বিশ তলার আধুনিক দালান, চকচকে কাঁচে মোড়া, অভিজাত এলাকায় নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এক নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে। বাইরে থেকে ঝাঁ-চকচকে দেখালেও ভিতরে শুরু থেকেই চলছিল দুর্নীতি।
প্রকল্পের সুপারভাইজার ছিলেন মৃগাঙ্ক ঘোষাল। অত্যন্ত চতুর, ক্ষমতাবান, আর দুর্নীতিপরায়ণ এক ব্যক্তি। প্রকল্পে বরাদ্দ ভালো মানের সিমেন্ট, রড, ইস্পাত — সব কিছুই বদলে দেওয়া হয় নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে। বাইরে থেকে সব কিছু ঠিকঠাক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে পড়ছিল পুরো গঠন।
মিস্ত্রিরা কিছুটা বুঝেছিল। কিন্তু দিনের শেষে তারা ছিল শ্রমিক — চাকরি আর দুটো পেট চালানোর দায়। কেউ মুখ খুলেনি।
একদিন হঠাৎ দুপুরবেলা, আষাঢ় মাসের প্রবল বৃষ্টিতে ১৩ তলার ছাদে কাজ চলছিল। চারিদিক জলের তোড়ে থরথর করে কাঁপছিল পুরো বিল্ডিং। হঠাৎ বিকট শব্দে ধসে পড়ে ছাদ — একটা সম্পূর্ণ অংশ ধ্বসে পড়ে নিচে।
পলকেই মৃত্যু হয় ২১ জন শ্রমিকের। চিৎকার, আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে যাওয়া প্রাণগুলো সহায়হীনভাবে ছটফট করতে থাকে।
এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন রামিজ নামে এক মিস্ত্রি ঘটনাস্থলে ছিল না। সে সেদিন হঠাৎই হসপিটালে গিয়েছিল — তার মায়ের চিকিৎসার জন্য।
দু’দিন পর যখন সে কাজে ফিরে আসে, তখন বিল্ডিংয়ের পরিবেশ পুরো পাল্টে গেছে। চারপাশে কড়া নিরাপত্তা, কোনো চেনা মুখ নেই। রামিজকে অফিসে ডেকে পাঠানো হয়।
সুপারভাইজার মৃগাঙ্ক ঘোষাল মুখে হাসি ধরে বলল, “দেখো রামিজ, আমরা তোমাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বিল্ডিংয়ের কাজ এখন নতুন মিস্ত্রিদের দিয়ে হবে। তোমার পাওনা টাকা আমরা দিচ্ছি, এরপর আর আসার দরকার নেই।”
রামিজ বিস্মিত। “কিন্তু হঠাৎ এমন কী হলো? লক্ষণ, করিম, রফিক, অন্য মিস্ত্রিরা কোথায়?”
মৃগাঙ্কের চোখে এক ঝলক কঠোরতা আসে। “তাদের দরকার নেই। তারা চলে গেছে। তুমি যাও।”
রামিজ টাকা নিতে চায়নি। সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে তার মনে। বন্ধু লক্ষণের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজের সময়ও তারা একসাথে খেত, হাসত, আড্ডা দিত। হঠাৎ করে এতগুলো মানুষ উধাও হয়ে গেল? কারোর কোনো খোঁজ নেই?
সে শহরের হাসপাতাল, থানায় যায়। কিছু পায় না। পরে গ্রামে ফিরে লক্ষণের বাড়িতে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন লক্ষণের স্ত্রী। তারা জানে না লক্ষণ কোথায়। ফোন বন্ধ, কেউ কিছু জানায়নি।
রামিজ তখন সব খুলে বলে। বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার ঘটনা, সুপারভাইজারের আচরণ, আর যাদের দেখেনি তারা সব নিখোঁজ।
লক্ষণের পরিবার হতবাক হয়ে যায়। তার মেয়ে — মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে — চোখের সামনে বাবাকে হারিয়ে শোকে নির্বাক হয়ে পড়ে। মা থানায় অভিযোগ করেন, কিন্তু পুলিশের তৎপরতা শুরু হয়েও থেমে যায়।
কারণ?
মৃগাঙ্ক ঘোষাল তাদের ‘ম্যানেজ’ করে নেয়।
অনেক টাকা খাইয়ে, উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে সমঝোতা করে, ঘটনাটা চাপা পড়ে যায়। ফাইল বন্ধ হয়ে যায়। রিপোর্ট লেখা হয়, “কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। মিস্ত্রিরা নিজের ইচ্ছায় কাজ ছেড়ে চলে গেছে।”
কিন্তু ঘটনা ঠিক সেখানেই শেষ হয়নি।
কোম্পানির ‘রেপুটেশন’ বাঁচাতে এক রাতে লুকিয়ে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে নতুন নির্মাণ বসানো হয়। ধ্বংসাবশেষের নিচে যাদের দেহাবশেষ পড়েছিল, তাদেরকে সরিয়ে না এনে, রাতের অন্ধকারে সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়।
এই ঘটনা ভুলে যায় সবাই। নতুন বিল্ডিং হয়, চাকচিক্য ফিরে আসে। কিন্তু যারা নিচে চাপা পড়ে গেল, তারা কি চুপ করে গেল?
না।
ধীরে ধীরে অফিসে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে থাকে। মাঝরাতে সাফাইকর্মীরা বলে — ফাঁকা তলায় হাতুড়ি পড়ার শব্দ শোনা যায়। কেউ বলে, লিফটে মাঝরাতে ১৩ নম্বর বোতাম জ্বলে ওঠে। কেউ বলে, কাজের সময় পেছনে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়, অথচ কেউ থাকে না।
কিন্তু সব কিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। হয় উপেক্ষা করা হয়, নয়তো চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।
তবে একমাত্র একজন মানুষ সত্যিটা জানে।
রামিজ।
সে বারবার ফিরে আসে বিল্ডিংয়ের আশেপাশে। সে জানে, এখানে কিছু একটা ঘটেছিল। ২১টা মানুষ একসাথে উধাও হয়ে যেতে পারে না। এর পিছনে রয়েছে বড় রহস্য। বড় অপরাধ। রামিজ নিজে সে অপরাধের কিনারা করতে পারেনি। সে মজদুর। শক্তিশালী কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। কিন্তু সে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে এমন কারো, যে এই সত্যি সামনে আনবে।
পর্ব ৪: মুখোশের আড়ালের মুখ
বর্তমান সময়
রাত তখন প্রায় ১টা। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ঘড়ির কাঁটার একটানা টিক টিক শব্দ। ইনফিনিটিক কর্পোরেশনের বিশাল বিল্ডিং তখন অন্ধকারে ঢেকে আছে, কেবল মাঝে মাঝে কোন ফ্লোর থেকে আলো ফোটে, আবার নিভে যায়।
তৃষা ও অজিত ধীরে ধীরে লিফট থেকে নামল ১৩ তলায়। এই প্রথমবার অজিত নিজে ওই ফ্লোরে এসেছে তৃষার সঙ্গে। এর আগে সে যতবারই কিছু বলেছে, কেবল ভয় দেখিয়ে বা সাবধান করে থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আজ — আজ সে নিজেই সামনে এগিয়ে এসেছে।
তৃষার হাতে ছিল একটা টর্চ। অজিতের হাতে পুরনো এক লোহার রড। তালাবদ্ধ সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তারা দুজন। তালার চারপাশে মরচে পড়েছে।
অজিত বলল, “তালা ভাঙবো তো?”
তৃষা চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আজ আর পেছনে ফিরবো না।”
দুজনের সম্মিলিত চেষ্টায় তালাটা ভেঙে পড়ে মাটিতে। দরজাটা ধীরে ধীরে কুঁই কুঁই শব্দে খুলে যায়। ভেতরে প্রবেশ করেই তারা বুঝতে পারে—এই ঘরটা অন্যরকম। এখানে শুধুই অতীত জমে আছে —ধু লোয় মোড়া, চাপা কান্নায় আচ্ছন্ন এক ঘর।
ঘরের এক কোণে ছিল একটি পুরনো আলমারি। সেটি খুলতেই তৃষার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ভিতরে ছিল একগাদা নথিপত্র — কাগজপত্র, পুরনো পে-স্লিপ, ডায়েরি, কাজের তালিকা, কিছু পাসপোর্ট সাইজ ছবি — সবই সেইসব শ্রমিকদের যাঁরা কাজ করতেন এই বিল্ডিং তৈরির সময়।
একটা খাম থেকে পড়ে যায় একটি ছবি — একজন মিস্ত্রির, পরনে সাদা গেঞ্জি, মাথায় গামছা বাঁধা। পেছনে লেখা নাম — “লক্ষণ ঘোষ”।
তৃষার চোখ ছলছল করে ওঠে। সে নিচু হয়ে ছবিটা হাতে তুলে নেয়। গলায় কান্না আটকে যায়।
অজিত পাশে এসে দাঁড়ায়। “দেখো, এটাই প্রমাণ। এখন এগোও। ভয় পেও না। যা হারিয়েছ, এবার তার বিচার পাওয়ার সময়।”
সকালবেলা তৃষা আর অজিত হাজির হয় থানায়। দায়িত্বরত অফিসার ছিলেন ইন্সপেক্টর সৌরভ মজুমদার। তারা সব নথি একে একে তার সামনে রাখে। ইন্সপেক্টর প্রথমে সন্দেহ নিয়ে দেখে, কিন্তু কাগজপত্র, ছবি আর তৃষার বর্ণনা শুনে তার কৌতুহল বাড়ে।
সৌরভ বলেন, “তোমরা যা বলছো, সেটা সত্যি হলে এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার! আমি পুরোনো কেস রেকর্ড খুঁজে দেখি।”
ঘন্টাখানেকের মধ্যে তিনি ফিরেও আসেন পুরনো রেকর্ডের একগাদা ফাইল হাতে। ফাইল খুলতেই দেখা যায় — “মিস্ত্রিদের নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ – ২০০৯”।
অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “সেই সময়কার অফিসার এই রিপোর্টগুলো ফাইল করে রেখে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তদন্ত চালাননি। কেসগুলো ফাইলের নিচে চাপা পড়ে গেছে। আর কেউ খোঁজ নেয়নি।”
এবার সৌরভ সত্যি ঘটনা জানার জন্য তদন্তের নির্দেশ দেন। একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়। ফরেনসিক টিম ডাকা হয়। ১৩ তলায় সিল করা জায়গা খোঁড়া শুরু হয়।
দুদিন ধরে চলে তদন্ত। জমাট ধুলো সরিয়ে বেরিয়ে আসে চাপা পড়া সত্য। সিমেন্টের নিচ থেকে উঠে আসে মানুষের হাড়, মাথার খুলি, ভাঙা যন্ত্রপাতি, ওয়ার্কারদের পোশাকের অংশবিশেষ।
সব কিছু প্রকাশ্যে এলেও, কে এই হত্যার জন্য দায়ী, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছিল না। মৃতদেহের পরিচয় জানা যাচ্ছিল না, কারণ ডিএনএ মিল না হলে আইনি প্রমাণ সম্ভব নয়।
ঠিক তখনই তৃষা এগিয়ে আসে।
“আমার নাম তৃষা ঘোষ। আমার বাবার নাম লক্ষণ ঘোষ। আমি সেই নিখোঁজ শ্রমিক লক্ষণের মেয়ে। আমি ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজি।”
ফরেনসিক টিম তৎক্ষণাৎ নমুনা সংগ্রহ করে। তৃষার রক্ত থেকে নেওয়া ডিএনএ নমুনা মেলানো হয় উদ্ধার হওয়া হাড়ের ডিএনএর সঙ্গে। পরীক্ষার ফল আসতে দুদিন লাগে।
ফলাফল আসে — ম্যাচ ১০০%।
এখন পুলিশের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ। ইনফিনিটিক কর্পোরেশনের তৎকালীন সুপারভাইজার মৃগাঙ্ক ঘোষালকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা দায়ের হয় — গাফিলতিজনিত গণহত্যা, প্রমাণ লোপাট, মৃতদেহ গোপনকরণ, জাল তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি ধারায়।
কোর্টে বিচার শুরু হয়। গণমাধ্যমে হইচই পড়ে যায়। অতীতে ধামাচাপা দেওয়া সত্য এবার আলোয় উঠে আসে।
কিছুদিন পর ১৩ তলায়, সেই তালাবদ্ধ ঘরটির সামনে, তৃষা দাঁড়িয়ে ছিল একা। হঠাৎ যেন একটা হাওয়ার ঝাপটা আসে ভিতর থেকে। মৃদু কণ্ঠে ভেসে আসে অনেকগুলো স্বর — কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও শান্তির দীর্ঘশ্বাস।
তৃষা যেন বাবার গলার শব্দ শুনতে পায় — “ধন্যবাদ মা… এবার শান্তি পেলাম…”
কয়েক সপ্তাহ পর, শহরের এক প্রান্তে ছোট্ট এক অনুষ্ঠানে শ্রমিকদের পরিবারদের ডাকা হয়। তৃষার হাতে সম্মাননা তুলে দেয় মেয়র। পরিবারগুলো একে একে এসে তৃষাকে জড়িয়ে ধরে। তাদের চোখে জল, কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা।
তৃষা একাই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সে একা ছিল না।
তার পেছনে ছিল ২১টি আত্মা—যারা আর চাপা পড়ে নেই। এবার তারা মুক্ত। শান্ত।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।