পর্ব ১: তালাবদ্ধ ঘর
নতুন বিয়ে হয়েছে অনিক আর তৃষার। চারদিকে এখনো বিয়ের আনন্দের রেশ লেগে আছে। আনুষ্ঠানিকতার ঝক্কি শেষ করে এবার নিজেদের মতো একটা সংসার গড়ে তোলার পালা। অনিকের অফিস শহরে, তাই ওদের গ্রাম ছেড়ে শহরের এক বহুতল আবাসনে ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটে ওঠে তারা।
ফ্ল্যাটটি পুরনো হলেও বেশ পরিপাটি। তিন রুম, এক রান্নাঘর, এক ডাইনিং এবং বারান্দাও আছে। ঘরটি মোটামুটি পরিষ্কার, তবে একটা ঘরে বড় তালা ঝুলছে। মালিক আগেই জানিয়ে রেখেছিল, “ঘরটা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করা হতো, এখন আর দরকার নেই। তালা খুলতে হবে না।” তৃষার তখনও সন্দেহ হয়নি। সবে বিয়ে হয়েছে, নতুন শহর, নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ—সবকিছুতেই যেন একটা হালকা উত্তেজনা আর আনন্দের ছোঁয়া।
ফ্ল্যাটের পাশের ঘরে থাকেন এক বৃদ্ধ দম্পতি—শ্রীযুক্ত রমেশ বাবু ও তাঁর স্ত্রী অনুরাধা দেবী। বয়স হয়েছে অনেক, তবে মিষ্টি মনের মানুষ। রোজ সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে তৃষার সঙ্গে গল্প করেন, কখনো চায়ের নিমন্ত্রণও দেন।
এক সন্ধ্যায় তৃষা কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কাকু, আমাদের ফ্ল্যাটের একটা ঘরে তালা মারা। আপনারা জানেন কিছু?”
প্রথমে রমেশ কাকু চুপ করে গেলেন। অনুরাধা কাকিমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বৌমা, ঐ ঘরের কাছে যেও না। কিছু জিজ্ঞেস করো না। শুধু বলছি, ঘরটা যেমন আছে, তেমনই থাকতে দাও। সন্ধ্যার পর বিশেষ করে দরজা ছুঁয়ো না।” তৃষা হেসে উড়িয়ে দিল, “আচ্ছা আচ্ছা কাকু। আমি তো ভয় পাই না! এটা তো আধুনিক সময়…” কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা অজানা শিহরণ বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে।
পরের দিন থেকেই তৃষা লক্ষ্য করল, প্রতিদিন সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে ঐ বন্ধ ঘর থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসে—কখনো যেন হালকা ঘষাঘষির শব্দ, কখনো দমকা বাতাসের মতো শোঁ শোঁ শব্দ, আবার কখনো কান্নার মতো চাপা আওয়াজ। প্রথম কয়েকদিন সেটাকে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে হয়তো পাশের ফ্ল্যাটের আওয়াজ আসছে। কিন্তু দিন দিন শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট হতে লাগলো। অনিক অফিসের কাজের চাপে রাত ৯টার আগে ফিরতে পারে না। তৃষা সারাদিন একা। ঘরের সব কাজ সে-ই করে, রান্না করে, পরিষ্কার করে। কিন্তু বিকেলের পরই যেন মনটা অজানা শঙ্কায় ভরে ওঠে।
তৃষা একদিন ফোনে অনিককে বলল, “শোনো, ঐ ঘর থেকে কেমন কেমন আওয়াজ আসে সন্ধ্যেবেলা। ভয় লাগছে আমার।” অনিক হেসে বলল, “আরে! পুরনো ফ্ল্যাট তো, কাঠের দরজা বা জানালায় আওয়াজ হতেই পারে। ভূতের ভয় পাচ্ছো নাকি?” তৃষা বিরক্ত হল, কিন্তু কিছু বলল না।
একদিন বিকেলে হঠাৎ তৃষার মাথায় খেলে গেল, “একবার ঘরটা খুলেই দেখি না কেন? কী এমন আছে তাতে? এতদিন তো বন্ধ ছিল, একটু দেখলেই বা কী এমন ক্ষতি হবে?” তৃষা অনেকক্ষণ দ্বিধায় ভুগল, তারপর সাহস করে এক চেনা তালাচাবি মিস্ত্রীকে ডাকল। মিস্ত্রী এসে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করল। সে বলল, “ম্যাডাম, এই ঘরে কেমন যেন একটা গন্ধ লাগছে। অনেকদিন বন্ধ থাকলে এমনটা হয় ঠিকই, তবে এই গন্ধটা… অদ্ভুত।”
তৃষা তাকে চাপ দিল, “দয়া করে খুলে দিন চাবি। আমি একবার দেখেই আবার বন্ধ করে দেবো।”
মিস্ত্রী তালা খুলল। শব্দটা “ক্লিক” করে খুলে গেল। ঘরের দরজা খোলা মাত্র একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন ঝাপটে মুখের ওপর এসে পড়ল। মিস্ত্রীর মুখের ভঙ্গি বদলে গেল। সে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় আচমকা চিৎকার করে উঠল — “উফফ! আমার পায়ে কী যেন ফুটলো!”
তৃষা চমকে গেল। মিস্ত্রীর পায়ে একটা মোটা লোহার পেরেক ঢুকে গেছে—মেঝের মাঝখান থেকে যেন আপনা আপনি বেরিয়ে এসে তার পায়ে বিঁধে গেছে। তৃষা তাড়াতাড়ি তার প্রাথমিক চিকিৎসা করলো। মিস্ত্রী পায়ে কাপড় বেঁধে, কোনো মতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ম্যাডাম, এই ঘর ভালো না। এই ঘরে কিছু আছে। আমায় ছাড়ুন, আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না!” সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিচে নেমে গেল। তৃষা কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে, আবার তালা দিয়ে দিল।
সে সেদিন রাতে আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। অনিক বাড়ি ফিরলে সব কিছু খুলে বলে, কিন্তু অনিক বলল, “ভয়ের কিছু নেই। হয়তো পুরনো কাঠের মেঝেতে পেরেক ছিলই। তুমি বেকার ভাবছো।”
কিন্তু তৃষার মনে হচ্ছে, ঘরের ভেতর কিছু ছিল—কিছু অদৃশ্য, কিছু ক্ষুধার্ত… যা ঘুমিয়ে ছিল এতদিন। আর আজ, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘুম ভেঙে গেছে।
রাতে শুয়ে পড়ে, কিন্তু চোখে ঘুম আসে না তৃষার। বারবার মনে পড়ে মিস্ত্রীর মুখের ভয়, তার দেহের কাঁপুনি। হঠাৎ মাঝরাতে দরজার ও-পার থেকে আবার সেই শব্দ—এইবার একটু জোরে, একটু স্পষ্ট। যেন কেউ হাঁটছে… ধীরে ধীরে… দরজার খুব কাছে। তৃষার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে অনিককে ডাকতে যায়, কিন্তু দেখে অনিক গভীর ঘুমে অচেতন। বারবার ডাকলেও সে উঠছে না। তারপর হঠাৎ—ঘরের ভেতর থেকে একটা চাপা শ্বাসের শব্দ…
পর্ব ২: নিস্তেজ জীবনের ছায়া
তালাবন্ধ ঘরটি খোলার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। তৃষা যেন আর আগের তৃষা নেই। যেই মেয়েটি এত প্রাণবন্ত ছিল, সেই এখন সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। চোখে ক্লান্তি, মুখে একরাশ উদাসীনতা। ঘুম যেন তার শরীর আর মন দুটোই গ্রাস করে নিয়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকমে দাঁত মাজে, এরপর আবার বিছানায়। দুপুরে রান্না করা হয় না, বা করলেও পুড়ে যায়। বাসন ভরা পড়ে থাকে সিঙ্কে, জামাকাপড় ধুয়ে উঠতে পারে না। অনিক প্রথমে এসবকে সাময়িক ক্লান্তি বলে ভেবেছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন শহর, একা থাকা—এসব কিছু হয়তো তৃষার ওপর চাপ ফেলেছে।
কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে।
একদিন রাতে অনিক অফিস থেকে ফিরে দেখে তৃষা রান্না ঘরে বসে আছে, চুল এলোমেলো, পাত্রে কিছু রান্না রাখা কিন্তু সেটি ঝলসে গেছে। গন্ধে ঘর ভরে গেছে। সে রেগে যায়, “তৃষা! তুমি কি সারাদিন কিছুই করলে না? আমার খেতে ইচ্ছে করে না বুঝি?”
তৃষা নিচু স্বরে বলে, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম… আবার মাথা ভার হয়ে গিয়েছিল…”
– “সব সময় মাথা ভার? তুমি কি অসুস্থ নাকি? না তুমি আমাকে অবহেলা করছো?” অনিকের গলা রূঢ় হয়ে ওঠে।
তৃষা কিছু বলে না, চুপ করে চোখ নামিয়ে রাখে। সেই চঞ্চল চোখ এখন যেন নিঃস্পন্দ, দৃষ্টি যেন শূন্যে।
কিন্তু এই নিস্তেজ অবস্থার মধ্যেও সন্ধ্যাবেলা তৃষা একটি অভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়—ঘরের দরজার ও-পার থেকে আসে চাপা কণ্ঠস্বর, শব্দ… যেন কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে, দেয়ালে নখ টানছে, কিংবা একটানা কাঁদছে।
প্রতিদিন, ঠিক সন্ধ্যার পর শুরু হয় এসব। প্রথমে সে ভাবত কল্পনা করছে, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অনিককে সে জানায়, “শোনো, ঐ ঘর থেকে প্রতিদিন অদ্ভুত আওয়াজ আসে। ঠিক যেন কেউ হাঁটছে, ফিসফিস করছে…”
অনিক বিরক্ত হয়, “আবার সেই ভূতের গল্প? এসব বলে নিজেই নিজেকে পাগল করে ফেলছো তৃষা। এসব কল্পনা বাদ দাও। দরজা বন্ধ, কিছু নেই ভিতরে।”
– “তুমি শুনতে পাও না, তার মানে তো এ নয় যে আমি কল্পনা করছি।”
– “তুমি আগে ডাক্তার দেখাও। আমার মনে হয় তোমার রেস্ট দরকার।”
এভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। তৃষার ভেতরে জমতে থাকে একাকীত্ব, অভিমান আর অজানা আতঙ্ক।
ওদিকে বৃদ্ধ রমেশ কাকু ও অনুরাধা কাকিমা সব কিছু লক্ষ করছিলেন। তৃষার ঘর অগোছালো, বারান্দায় আর আসে না, চোখে মুখে চেহারার যেন একটা ক্লান্তি। একদিন রমেশ কাকু নিজে এসে অনিকের সঙ্গে কথা বলেন।
– “বাবা অনিক, কিছু মনে কোরো না… তোমার স্ত্রীর শরীরটা কেমন যেন মনে হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটছে। বলো তো, ঐ তালাবদ্ধ ঘরটা কি কেউ খুলেছে?”
অনিক একটু চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ, তৃষা একদিন একটা মিস্ত্রী ডেকে এনে খুলেছিল। তারপরেই তো ওর এইরকম লাগছে। আপনি কিছু জানেন কাকু?”
রমেশ কাকু এক নিঃশ্বাসে বললেন, “বাবা, অনেক বছর আগেও এই ঘর নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। আমরা মালিককে বলেছিলাম ঘরটা সিল করে দিতে। তখন থেকেই বন্ধ ছিল। এই ঘর ভালো নয়। তোমাদের যা হয়েছে, সব এর ফল।”
– “আর এক কথা—যে মিস্ত্রী দরজা খুলেছিল, তাকে কি পরে আর দেখেছো?”
– “না, সে তো চোট পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিনই।”
– “খোঁজ করো তাকে। দেখি সে ঠিক আছে কিনা।”
তাদের কথামতো অনিক খোঁজ শুরু করল। ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড বলল, “হ্যাঁ, একটা লোক এসেছিল সেদিন, তবে নাম-ঠিকানা কিছু দেয়নি।”
অনিক এক অটো ড্রাইভারের সাহায্যে পৌঁছে গেল মিস্ত্রির বাড়িতে। কিন্তু বাড়ির সামনে তার স্ত্রী বলল, “ও তো মাতাল। মাঝেমাঝে দিন দুই গায়েব হয়ে যায়। কে জানে কোথায় আছে আবার।”
অনিক উদ্বিগ্ন হল। যাকে দরজা খুলতে দেখা গেছে, সে যদি হারিয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা কি শুধু কাকতালীয়?
থানায় যোগাযোগ করল অনিক। ডিউটির অফিসার ছবি দেখে বলল, “এই লোক তো আমাদের জানা আছে। ও একাধিকবার চুরির জন্য ধরা পড়েছে। মাঝেমাঝেই পালায়, তবে ফিরে আসে। আমরা খোঁজ নিচ্ছি।”
এরপর কেটে যায় আরও একদিন।
তৃষার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, রাত জেগে থাকে, অদ্ভুত কিছু ভাষায় বিড়বিড় করে। মাঝে মাঝে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হাসে, আবার হঠাৎ কাঁদতে থাকে।
সেদিন রাতেই থানার একজন অফিসার ফোন করে জানায়, “পাশের শহরের মর্গে এক আওয়ারিশ মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সম্ভবত রোড অ্যাক্সিডেন্ট। ছবি দেখে চিনতে পারলে ভালো হয়।”
অনিক দ্রুত সেই অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
তাদের সঙ্গে ছিল মিস্ত্রির স্ত্রীও। লাশ দেখার পর সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
– “হ্যাঁ… ও-ই আমার স্বামী।
অনিক হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। – “তাহলে যেদিন সে ঘর খুলেছিল, সেদিনই… সেদিনই ওর মৃত্যু হয়েছিল?”
তৃষার মনে পড়ে গেল মিস্ত্রির সেই কাঁপা গলায় বলা কথাগুলো, “এই ঘরে কিছু আছে… কিছু আছে…”
সব কিছু যেন একটা অন্ধকার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। তৃষা কেবল অসুস্থ নয়, তার ভেতর কিছু প্রবেশ করছে… হয়তো সেই কিছুই, যাকে ঘর খুলে তৃষা ছেড়ে দিয়েছিল। তৃষার নিস্তেজ দেহের মধ্যে এক অচেনা প্রাণের গন্ধ যেন অনুভব করছে অনিক… আর সেই তালাবদ্ধ ঘরের দরজা, আবার যেন ধীরে ধীরে কাঁপছে।
পর্ব ৩: কাজরির মুক্তি
তৃষার গল্পে আমরা একটু পরে আসছি, তার আগে আমরা জানবো তৃষার মতই তারই বয়সী এক মেয়ে কাজরির কথা।
কাজরি গ্রামের মেয়ে, বাড়ি বাঁকুড়া। শালপাতা, তালপাতা আর টালির ঘরের মাঝে বেড়ে ওঠা এক প্রাণবন্ত, চঞ্চল মেয়ে। গ্রামের লাল মাটির রাস্তা, খোলা মাঠ আর নদীর ধারে ছুটে বেড়ানোই ছিল তার শৈশব। তার হাসি ছিল খোলামেলা, চোখ ছিল স্বপ্নময়।
গ্রামের লোকজন বলত, “ও মেয়ে তো যেন সিনেমার! শরীরটা কি দারুণ গড়া!” কিন্তু কাজরি এসব নিয়ে ভাবত না। তার জীবনে তখন ছিল একটাই চিন্তা—তার অসুস্থ বাবাকে বাঁচাতে হবে।
বাবা বহুদিন ধরে বুকে ক্যান্সারের যন্ত্রণায় ভুগছিল। শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে, কিন্তু দরিদ্র কৃষকের পক্ষে এত টাকা কোথা থেকে আসবে?
সেই সময়ই গ্রামের ফ্যাক্টরির মালিক সোমেশ মিত্র তার সামনে সুযোগের ছদ্মবেশে এসে দাঁড়াল।
– “শুনেছি তোমার বাবা খুব অসুস্থ,” বলল সে, “তোমার যদি কাজের দরকার হয়, আমি আমার শহরের অফিসে একটা ব্যবস্থা করতে পারি। মাসে মাসে ভালো টাকা দেবে। শুধু আমার ফ্ল্যাটে থেকে সাহায্য করলেই হবে।”
অভাব, অসহায়তা, আর বাবাকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা কাজরিকে হ্যাঁ বলাতে বাধ্য করল।
তিন বছর আগে শহরের সেই ফ্ল্যাটে এসে ওঠে কাজরি। প্রথম কয়েকদিন সব ঠিকই ছিল। তারপর ধীরে ধীরে খোলস ভাঙতে শুরু করল সোমেশ মিত্র।
সেই ফ্ল্যাটেই শুরু হল নির্যাতন—শরীরী অত্যাচার, মানসিক নিপীড়ন। কাজরি বাধা দিতে চেয়েছিল, অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোমেশ তার পরিচয়, দুর্বলতা, গরিবত্ব—সব কিছুকে অস্ত্র করে কাজরিকে আটকে রেখেছিল।
সে শুধু ধর্ষণ করত না, কাজরিকে দিয়ে চালাত দেহব্যবসা। বাইরের লোক এলে তার “বিনোদনের উপকরণ” হিসেবে ব্যবহার করত কাজরিকে। তাকে বন্ধ ঘরে আটকে রাখত দিনের পর দিন। আর সেই ঘরটিই আজ তৃষার আতঙ্কের উৎস।
একদিন কাজরি আর সহ্য করতে পারেনি। বদ্ধ ঘরের ভেতর, অসহায়ভাবে আত্মসম্মান আর শরীরের শেষ কণাটি দিয়ে লড়াই করছিল সে। সেই দিন সোমেশ আবার তার ওপর চড়াও হয়। অমানবিক মারধরের এক পর্যায়ে, কাজরি দমবন্ধ অবস্থায় শেষ চেষ্টায় তাকে ধাক্কা মারে।
সেই ধাক্কায় সোমেশ সামান্য আহত হলেও, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে যায়। কানে কানে বলে,
– “তুই আমার মুখ কালো করলি? এবার তোকে এই ঘরেই শেষ করবো।”
সেই রাতে, ঠিক তিন বছর আগে, কাজরিকে খুন করে সোমেশ। পাথরের দেওয়ালের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় তার নিথর দেহ। তারপর ইট, সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেয় সেই ঘর। বাইরের মানুষ জানেই না সেখানে এক মেয়ে চিরদিনের ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তৃষার মতো মেয়ের কাছে সেই ঘর শুধুই একটা তালাবদ্ধ কক্ষ, অথচ তার অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। যা এদের কাছে এখনও অজানা। তৃষার শরীর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। সে আর স্বাভাবিক নয়, মনে হচ্ছে কেউ বা কিছু তার শরীর দখল করে ফেলেছে। ভয়, কান্না, ক্রোধ সব একসাথে যেন তার ভেতরে মিশে গেছে।
রাত্রে দরজার ও-পার থেকে আসা আওয়াজ, দেয়ালে আঁচড়ের শব্দ, নিজের মধ্যেও এক অচেনা আচরণ—সবকিছু মিলিয়ে অনিক অবশেষে বুঝে যায়, কিছু একটা তো ঘটছেই।
বৃদ্ধ দম্পতির উপদেশ অনুযায়ী, অনিক এক অধ্যাপক ও আত্মা বিশারদ ড. বিমল ঘোষাল-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ড. ঘোষাল এক সন্ধ্যায় আসেন ফ্ল্যাটে। ঘরে ঢুকেই থমকে যান তিনি।
– “এই ঘরের মধ্যে কিছু আটকে আছে,” বলেন তিনি।
– “এই দেয়ালের পেছনে…”
তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে কিছু মন্ত্র জপ করেন। তারপর একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার তরঙ্গ অনুভব করেন। আস্তে আস্তে ঘরের তাপমাত্রা নামতে থাকে। বাতাস ভারী হয়। ঘরের ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ কেঁপে ওঠে।
– “আমি কাজরি… আমাকে কেন মেরে ফেললো?… আমি তো শুধু বাবাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম…”
তৃষার শরীর হঠাৎ ঝাঁকুনি খায়। সে চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করে, “আমি কাজরি… আমি মুক্তি চাই… আমি শান্তি চাই… আমি শুধু বিচার চাই।”
ড. ঘোষাল চোখ মেলে বলেন, “তৃষা কোনো কল্পনা করছে না। এই ঘরের ভেতর সত্যিই একটি আত্মা আছে। এবং তার মৃত্যু হয়েছে নির্মম হত্যায়। যদি বিচার না হয়, তবে সে মুক্তি পাবে না। বরং আরও অস্থির হয়ে উঠবে।”
অনিক আর দেরি করে না। সে পুলিশে খবর দেয়। পুরো ঘটনাটি জানায়। পুলিশ আসে, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে ঘর খোঁজে। এক প্রাচীন প্রলেপ সরিয়ে ফেলার পর এক দেয়ালের পেছন থেকে বের হয় মানুষের হাড়গোড়ের কঙ্কাল। সেই সঙ্গে কিছু মেয়েদের পোশাক, অলংকার আর কাজরির নাম লেখা একটি পুরনো চিঠি। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। প্রমাণ মেলে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণসহ এই ফ্লাটের মালিক তথা সেই ফ্যাক্টরির মালিক সোমেশ মিত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে সে কাজরি হত্যার কথা স্বীকার করে। সেদিন রাতে তৃষা প্রথম শান্তিতে ঘুমায়। দরজার ও-পার থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। সকালে উঠে দেখে, ঘরের তালা নিজের মতো খুলে পড়ে আছে। ঘরের ভিতর আর কোনো শীতল হাওয়া নেই, নেই অদ্ভুত গন্ধ।
কাজরি চলে গেছে—নির্মম পৃথিবীর বেড়াজাল ভেঙে এক নতুন জগতে। তার চোখে ছিল অশ্রু, কিন্তু মুখে ছিল শান্তির হাসি। তৃষা জানে, সে শুধু একটি আত্মাকে মুক্তি দেয়নি—এক ভয়ঙ্কর সত্যকে সামনে এনে সমাজের মুখোশ ছিঁড়ে দিয়েছে। আর সেই তালাবদ্ধ ঘর? সে আজও আছে। কিন্তু আজ সেখানে শুধু নিঃস্তব্ধতা। শান্তির নিঃস্তব্ধতা।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।