শহরের এক কোণে, গাছপালায় ঘেরা একটি পুরনো বাড়িতে একা থাকেন অনিলবাবু। বয়স প্রায় বাহাত্তর। মাথার চুল সাদা, মুখে বলিরেখা, হাঁটার সময় লাঠির ভর। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য—তিনি তাঁর অতীত ভুলে গেছেন।
ডাক্তার বলেছেন, বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশ। অনিলবাবু নিজেই জানেন না তিনি কে ছিলেন, কী করতেন, বা কাদের সঙ্গে ছিলেন। মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে ভয় পান—এ লোকটা কে?
কেউ কাছে আসে না। স্ত্রী বহু বছর আগেই মারা গেছেন, ছেলেমেয়ে বিদেশে, বছরে একবার ফোন আসে কি না সন্দেহ। পরিচারিকা আসে সকালে রান্নাবান্না করতে, সন্ধ্যায় তালা দিয়ে চলে যায়।
এই একঘেয়ে, স্মৃতিশূন্য জীবনের মধ্যেই হঠাৎ একদিন ঘটল কিছু অদ্ভুত।
ভোরবেলা দরজা খুলতে গিয়ে তিনি দেখলেন, দরজার নিচে গড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট খাম। খুলে দেখলেন, ভিতরে একটি হাতের লেখা চিঠি। তাতে লেখা:
“স্মৃতি ১: তুমি একদিন বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে চা খেতে চেয়েছিলে। আমি সেই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি বলেছিলে, ‘ভিজে গেলে জ্বর হবে, কিন্তু মনটা ভরে যাবে।’ সেদিন আমি প্রথম হাসি দেখেছিলাম।”
চিঠির নিচে কোনো নাম নেই।
অনিলবাবু অবাক হয়ে বসে পড়লেন।
তিনি কিছুই মনে করতে পারছেন না, কিন্তু এই কথাগুলো পড়তেই বুকের ভিতর কেমন যেন হুহু করে উঠল। যেন কোনও গভীর জায়গা থেকে কিছু জেগে উঠছে।
পরদিন সকালে আবার এক খাম।
“স্মৃতি ২: তোমার লেখার টেবিলে একটা ছোট রেডিয়ো ছিল, যেটায় তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে রাখত। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা তুমি সে গানে গলা মেলাতে। আমি দূর থেকে শুনতাম, আর ভাবতাম—এই মানুষটা আমার জীবনের সুর।”
তিনদিন, চারদিন, একেকটা দিন, একেকটা খাম।
প্রতিটা খামে লেখা থাকে একেকটা স্মৃতির টুকরো। কখনও কলেজ জীবনের, কখনও কোনও ভ্রমণের, কখনও এক নির্জন চিঠির, কখনও এক ঝগড়ার রাতের।
ধীরে ধীরে, অনিলবাবুর মন যেন সেই অজানা অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতে থাকে।
একদিন তিনি খুঁজে বের করলেন তাঁর পুরনো ট্রাঙ্ক। ভেতরে কিছু ছবি, কিছু পুরনো চিঠি, একটি চা-দাগ দেওয়া বই—সব মিলিয়ে টুকরো স্মৃতির চিহ্ন।
চিঠির ভাষা, শব্দচয়ন দেখে তিনি বুঝতে পারেন—চিঠিগুলো লিখছে এমন কেউ, যে তাঁকে খুব ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসা এখনও মরে যায়নি।
একদিনের চিঠিতে লেখা ছিল—
“স্মৃতি ৯: তোমার পছন্দ ছিল নীল জামা আর সাদা প্যান্ট। আমার সবসময় মনে হত, তুমি আকাশ আর মেঘের মাঝের মানুষ। সেই আকাশটা এখন ঘোলাটে, কিন্তু আমি প্রতিদিন তাকে রং দিই এই চিঠির মধ্য দিয়ে।”
অনিলবাবু প্রথমবার চোখে জল এনে কাগজটা বুকের কাছে টেনে নিলেন।
এখন প্রতিদিন ভোরবেলা, তাঁর ঘুম ভাঙে নতুন চিঠির আশায়।
একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—এই রহস্যময় লেখককে খুঁজে বের করবেন। তিনি খেয়াল করলেন, চিঠিগুলো সব হাতে লেখা, কিন্তু কাগজের এক কোণে ছোট করে লেখা থাকে ‘R.P.’ এই দুটো অক্ষর।
রানুর কথা মনে পড়ে—তাঁর কলেজের বন্ধু, পরবর্তীতে প্রেমিকা। যাঁর নাম ছিল রূপা পাঁজা। কিন্তু তাঁর তো অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল… আর তারপর যোগাযোগও ছিল না।
একদিন সাহস করে তিনি পাড়ার এক বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে বলে পাঠান—“দেখো তো, কেউ ভোরবেলা এই চিঠি রেখে যায় কি না।”
পরদিন সেই ছেলে বলে, “এক দিদিমণি আসে। সাদা শাড়ি পরে। চুলে রূপোলি ঝলক। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি বললেন ‘আমি শুধু একটা গল্প শুনিয়ে যাই।’”
আরেকদিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনিলবাবু নিজে অপেক্ষা করেন।
ভোরের আলো ঠিক ফুটছে, তখনই আসেন এক বৃদ্ধা মহিলা। চোখে চশমা, মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
তিনি চিঠি রেখে পেছন ফিরতেই অনিলবাবু ডাক দেন—
“রূপা!”
মহিলা থেমে যান। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ান।
দুই জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত।
তারপর রূপা বলেন, “তুমি ভুলে গিয়েছিলে সব, তাই আমি মনে করাতে চেয়েছিলাম… একটুকরো করে। কারণ তুমি না থাকলে, আমি কে—সেটাও ভুলে যেতাম।”
অনিলবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের কোণে জল। তারপর তিনি এক পা এগিয়ে গিয়ে বলেন—
“এসো। আজ আর গল্প লিখে রেখে যেও না। আমার সঙ্গে বসে বলো—আমরা একসঙ্গে কত গল্প লিখেছিলাম!”
সেদিন থেকে আর কোনও খামে লেখা চিঠি আসে না।
কারণ সেই গল্প এবার একসঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে নতুনভাবে।
স্মৃতি আর বর্তমান—দুজন মানুষ, এক হারিয়ে যাওয়া সময়, আর এক ভালোবাসার পুনর্জন্ম।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।