কলেজ লাইফের শেষ বছর। প্রতিদিন সকালে কলেজে যাওয়ার সময় ট্রেনে উঠত অনিন্দিতা। সে তেমন মিশুক ছিল না, নিজের বই, গান, আর জানালার বাইরের দৃশ্যই ছিল তার সঙ্গী। তবে একদিন তার চোখে পড়ে একটি ছেলেকে—সাদা শার্ট, গম্ভীর চোখ, কানে হেডফোন। ছেলেটি প্রতিদিন জানালার ধারে বসে, কিছু না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন পৃথিবীর সব কথামালার ঊর্ধ্বে সে।
প্রথমে কৌতূহল, পরে অভ্যাস আর শেষে তা গড়ায় একতরফা ভালোবাসায়। অনিন্দিতা নিজেও বুঝতে পারেনি কবে সে ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছে। ছেলেটির নাম, পরিচয় কিছুই জানে না, শুধু জানে—প্রতিদিন এই ট্রেনটাই তাদের দেখা হওয়ার একমাত্র মাধ্যম।
একদিন সাহস করে অনিন্দিতা একটা ছোট চিরকুট লেখে—
“তোমার চুপচাপ থাকা আমাকে কথা বলাতে শেখায়। তুমি জানো না, কিন্তু আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি।”
চিরকুটটা সে রেখে দেয় ছেলেটির ব্যাগের পাশে। এরপর থেকে প্রতিদিনই সে একটি করে চিঠি রেখে যেতে থাকে—কখনো কবিতা, কখনো অনুভব, কখনো স্রেফ গুড মর্নিং।
ছেলেটির নাম ছিল ঋষভ। সে তখন কলেজ শেষ করে চাকরির খোঁজে ছুটছে। প্রতিদিনের দুশ্চিন্তা, ইন্টারভিউর টেনশন, পরিবারে চাপ—সব কিছুর মাঝে একটা ট্রেনযাত্রা ছিল তার নীরব বিশ্রাম। সে টের পেত, কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, কোনো অদৃশ্য আলো তার নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে একটু উষ্ণতা এনে দিচ্ছে।
একদিন, একটা ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে, হঠাৎ তার চোখ পড়ে ব্যাগের এক কোণে রাখা একটি চিঠিতে। খোলার পর সে এক মুহূর্ত থমকে যায়।
“আমি মন দিয়ে তোমার পাশে আছি। তুমি সফল হও—এই চাওয়া আমার।”
ঋষভ প্রথমবার অনুভব করল, কেউ একদম অন্তর থেকে তার কথা ভাবছে। তার নিজের জীবনের যন্ত্রণায় একটুও প্রকাশ না করে, অপরিচিত কারও প্রতি একতরফা ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে প্রতিদিন সে খুঁজে বেড়ায় সেই মেয়েটিকে।
দিন কেটে যায়। একদিন ট্রেনের ভিতর অনিন্দিতার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে কিছুটা আন্দাজ করে ফেলে। মেয়েটির মুখে এক রহস্যময় হাসি, চোখে লজ্জার রেখা আর ট্রেন থামার আগেই হঠাৎ নামার অভ্যাস তাকে বোঝায়—এই মেয়েটিই।
পরদিন, ট্রেন থেকে নেমে সে মেয়েটিকে অনুসরণ করে। মেয়েটি একা হেঁটে চলেছে কলেজের দিকেই। শহরের ব্যস্ততা কাটিয়ে তারা এক নির্জন গলির মোড়ে পৌঁছায়। মেয়েটি বুঝতে পারে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ঋষভ দাঁড়িয়ে।
ছেলেটি সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলে,
— “তুমিই কি আমাকে চিঠি লেখ?”
মেয়েটির মুখ ফর্সা হলেও সেই মুহূর্তে যেন লাল হয়ে ওঠে। চোখ নামিয়ে একটু চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ, আমিই।”
ঋষভ হালকা হেসে বলে,
— “জানো, আমি অনেক দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেউ আমাকে এত ভালোবাসতে পারে, চেনা না জেনা, কিছুরই তো মানে নেই…।”
— “ভালোবাসা মানে কি সব সময় পরিচয় দরকার?”—মেয়েটির শান্ত উত্তর।
ঋষভ একটু থেমে বলে,
— “আমি এক বেকার ছেলে। পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। প্রতিদিন চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। পরীক্ষায় বসছি। প্রেমের মত বিলাসিতার সময় আমার নেই। আমি এই মুহুর্তে বিয়েও করতে পারবো না। তুমি আমি ভালো বন্ধু হতে পারি। তবে এর বেশি কিছু দেওয়ার মত সামর্থ্য আমার নেই।”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর খুব ধীরে বলে,
— “আমি অপেক্ষা করবো।”
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।