রাত তখন সাড়ে ন’টা। অফিস থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে মেট্রো স্টেশনের দিকে ছুটছে রাহুল। আজ মা’র ওষুধ আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। মা’কে কথা দিয়েছিল, রাত দশটার আগেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শেষ ট্রেনটা যদি মিস করে, তাহলে শহরের এই প্রান্ত থেকে বাড়ি ফেরা সত্যিই মুশকিল হয়ে যাবে।
মোবাইলে বারবার সময় দেখে নিচ্ছে রাহুল। হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু শরীরে ঘাম। হালকা দমকা হাওয়া বইছে, তবুও তার গায়ে লেগে আছে একধরনের অস্বস্তিকর উত্তাপ — এই ভয়, এই দুশ্চিন্তা যে হয়তো শেষ ট্রেনটা মিস করে দেবে!
স্টেশনের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে রাহুল ছুটে গেল প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই সে থমকে দাঁড়াল। শেষ ট্রেনটা ঠিক এক মিনিট আগে ছেড়ে দিয়েছে। তার চোখের সামনে মেট্রো রেলের আলো মিলিয়ে গেল টানেলের অন্ধকারে। যেন তার সব চেষ্টা মুহূর্তে অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
রাহুল হাঁপাতে হাঁপাতে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। মাথার ভেতর তখন একগুচ্ছ চিন্তার ছায়া— মা চিন্তা করবে, কীভাবে ফিরবে এত রাতে, এমন অবস্থায় কেব্-ও পাওয়া যায় না সহজে।
ঠিক তখনই, রাহুলের পাশে এসে দাঁড়ালেন একজন বৃদ্ধা। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। হাতে কাঠের লাঠি, পরনে সাদা শাড়ি, গলায় একগাছা রুদ্রাক্ষর মালা। তাঁর চোখে ছিল অদ্ভুত এক শীতলতা আর মলিন হাসি।
বৃদ্ধা বললেন, “এই ট্রেন তোমার জন্য ছিল না, ছেলেটা। তোমার ট্রেন তো এখনই আসবে।”
রাহুল চমকে উঠে তাকাল বৃদ্ধার দিকে, “মানে? শেষ ট্রেন তো চলে গেছে!”
বৃদ্ধা একটু হেসে বললেন, “সব ট্রেন ঘড়ির সময় দেখে চলে না। কিছু ট্রেন আসে ভাগ্যের টানে। তুমিও আজ সেই ট্রেনটাই ধরবে।”
রাহুল অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই, স্টেশনজুড়ে একটা ধাতব শব্দ ছড়িয়ে পড়ল। রেললাইনের ভিতর থেকে ভেসে এলো এক অচেনা আওয়াজ— না মেট্রোর শব্দ, না লোকাল ট্রেনের। তবুও তা যেন কোথাও চেনা। যেন বহুদিনের পরিচিত কিছুর ডাক।
রাহুল উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, টানেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটি পুরনো ডিজাইনের ট্রেন, যেন ব্রিটিশ আমলের স্টিম ইঞ্জিন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, স্টেশনের কাউকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করতে দেখা যাচ্ছে না। কেউ যেন এই ট্রেনটা দেখতেই পাচ্ছে না।
বৃদ্ধা তখন বললেন, “চলো, এটা তোমার ট্রেন। সময় এসেছে।”
রাহুল কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, যেন এক অদৃশ্য টানে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে গেল আপনা থেকেই। ভিতরে ঢুকতেই গা ছমছমে একটা শীতল বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে গেল। আলো নেই, কিন্তু একটা স্নিগ্ধ আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে।
ট্রেনে যাত্রী বলতে কয়েকজন— কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ জানালার দিকে চেয়ে আছে। কারও চোখে কোনো শব্দ নেই, শুধু নীরবতা।
হঠাৎ এক কামরায় গিয়ে রাহুল দেখল, তার বাবা বসে আছেন। সেই বাবাকে, যিনি তিন বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। রাহুল স্তম্ভিত। চোখ ফেটে জল এসে যায়। “বাবা! আপনি… আপনি এখানে কী করছেন?”
বাবা তাকিয়ে শুধু হেসে বলেন, “তুই তো আমার ট্রেনটা মিস করেছিলি তখন। তাই তোকে নিতে এলাম।”
রাহুল তখন বুঝতে পারে, এই ট্রেন শুধু একটি ট্রেন নয়— এটা সময়ের ট্রেন। যেখানে অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে যায়। যেখানে অসমাপ্ত সম্পর্কগুলো আবার জোড়া লাগে।
সেই মুহূর্তে আবার সেদিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে— বাবার মৃত্যুর দিন অফিসের কাজে আটকে পড়ে রাহুল সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছতে পারেনি। সেই অপরাধবোধই এতদিন তার ভিতরে জমে ছিল।
বাবা হাত বাড়িয়ে বললেন, “তুই এখনো সময় পাসনি, রাহুল। যা, ফিরে যা। এবার যেন শেষ ট্রেনটা না মিস করিস।”
চোখ মেলে দেখে রাহুল নিজেকে সেই একই বেঞ্চে বসে পায়। স্টেশনটা খালি, ট্রেনও নেই। শুধু তার কানে বাজে বাবার বলা শেষ কথাগুলো।
হাতের মোবাইলে সময় দেখে— রাত ৯টা ৫৫। কী করে সম্ভব? ট্রেন তো মিস করেছিল!
ঠিক তখনই ঘোষণায় ভেসে এলো— “শেষ মেট্রো ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসছে।”
রাহুল উঠে দাঁড়াল। চোখে অশ্রু, মুখে হাসি। এবার সে জানে, জীবনে কিছু ট্রেন সত্যিই ভাগ্যের হয়। আর কিছু সম্পর্ক— সময় গেলেও ফুরায় না।
শেষ ট্রেনটা এবার সে ঠিক ধরতে পেরেছে।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।