নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে রিমা ও তার পরিবার। বাবা একটি সরকারি চাকরির কারণে শহরের প্রান্তে এই পুরনো দোতলা ভাড়া নিয়েছেন। বাড়িটা বেশ শান্ত — চারপাশে গাছপালা, একটু পুরনো ধাঁচের কাঠের দরজা-জানালা, আর প্রতিটি ঘরে এক অদ্ভুত গন্ধ—যেন ধুলো, সময় আর বিস্মৃতির মিশ্রণ।
রিমার ঘরটা ছিল দোতলার কোণে। জানালার পাশে একটা লোহার খাট, আর দেয়ালে টাঙানো বিশাল একটা পুরনো আয়না, যেটা আগে থেকেই ঘরে ছিল। আয়নাটা দারুণ নান্দনিক—বাঁধানো কাঠের ফ্রেম, তার গায়ে সাপের মত কারুকাজ। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকছিল রিমার।
প্রথম রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দাঁত মাজার সময় আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে। চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। আয়নায় তার নিজের প্রতিচ্ছবি যেন একটু দেরিতে নড়ে উঠল! সে চোখ নাড়ালো, আর আয়নার মানুষটা যেন একটু পরে প্রতিক্রিয়া দিল।
“এটা তো… সম্ভব নয়,” ফিসফিস করল রিমা।
সে নিজের হাত নাড়ল — আয়নার মানুষটাও নাড়ল, কিন্তু চোখে মুখে একটা আলাদা অভিব্যক্তি, যেন কোথাও একটা বেদনার ছাপ। রিমা সেদিন ব্যাপারটাকে ভুল ভেবে পাশ কাটিয়ে যায়।
দিন যেতে থাকে। কিন্তু রোজ রাতে, যখন সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখনই অনুভব করে — আয়নার মানুষটা তার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং আরেক “রিমা”। তার মতই দেখতে, কিন্তু চোখে গভীর ক্লান্তি, মুখে বিষণ্ণতা, যেন অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ফিরে আসা এক প্রতিবিম্ব।
একদিন রাতে সে সাহস করে বলে ফেলে, “তুমি কে?”
আয়নার মানুষটা চমকে তাকায়। এবার স্পষ্টভাবে সে ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কোনো শব্দ আসে না। শুধু ঠোঁটের গঠন দেখে রিমা বুঝতে পারে—সে বলছে, “আমি তুমি… ভবিষ্যতের তুমি।”
রিমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। “ভবিষ্যতের আমি? তুমি এখানে কী করছো?” সে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে।
আয়নার রিমা এবার চোখ মেলে তাকায় তার দিকে, তারপর দেয় এক দীর্ঘশ্বাস। জানালার পাশে বসে থাকা চেয়ারটা হঠাৎ নিজে থেকেই সামান্য দুলে ওঠে। রিমা চমকে পেছনে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই।
এরপর কয়েক রাত ধরে রিমা প্রতিরাতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নার মানুষটা তার সঙ্গে নীরব কথোপকথনে মেতে ওঠে। ঠোঁটের ভাষা বুঝে সে জানতে পারে—এই আয়না সাধারণ নয়। এটা একটা সময়ের ফাঁক, যেখান দিয়ে ভবিষ্যতের কিছু অংশ আটকে রয়েছে। ভবিষ্যতের রিমা এই আয়নার মধ্যে আটকা পড়েছে, কারণ তার জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল যা সময়কে বিকৃত করে দিয়েছে।
“কী ঘটেছিল?” একরাতে জানতে চায় রিমা।
প্রতিবিম্ব তখন চোখ বুজে মাথা নাড়ে। ঠোঁটে উঠে আসে একটি নাম — “রুদ্র”।
রিমা চমকে ওঠে। রুদ্র তার কলেজের এক বন্ধুর নাম, কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা কখনো ছিল না। “সে-ই কি তোমার জীবন বদলে দিয়েছিল?”
প্রতিবিম্ব কিছু বলে না, শুধু এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার চোখ থেকে। সেই অশ্রু যেন আয়নার কাচ বেয়ে রিমার গাল ছুঁয়ে পড়ে — অবিশ্বাস্য, অথচ সত্যি।
রিমা এবার ভয় পায় না। সে প্রতিজ্ঞা করে, ভবিষ্যতের নিজেকে এই ফাঁদ থেকে মুক্ত করবে।
পরদিন সে রুদ্রের খোঁজ নেয়। জানতে পারে, রুদ্র কয়েক মাস আগে মাদকাসক্ত হয়ে এক ভয়ঙ্কর চক্রে জড়িয়ে পড়ে। রিমা বুঝতে পারে, ভবিষ্যতের সে হয়তো রুদ্রকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই ধ্বংসের পথে গিয়েছিল।
সে এবার রুদ্রকে ফোন করে। কয়েকদিন কথা বলে, পাশে দাঁড়ায়। রুদ্র ধীরে ধীরে আসক্তি থেকে সরে আসে, পরিবারে ফিরে যায়।
এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিমা। এবার প্রতিবিম্বে সেই মানুষটা নেই। শুধু তার নিজের মুখ, সম্পূর্ণ নিখুঁত প্রতিফলন। কোনো দেরি নেই, কোনো কান্না নেই, শুধু এক অভূতপূর্ব শান্তি।
রিমা আয়নাটার দিকে চেয়ে হাসে। আয়না এবার নিঃশব্দে প্রতিক্রিয়া দেয়, ঠিক যেমন হওয়া উচিত। যেন ভবিষ্যত নিজে থেকেই ঠিক হয়ে গেছে।
সেই রাতের পর থেকে আয়নাটা আর কিছু বলে না, আর কোনো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে না।
কিন্তু রিমা জানে—সব আয়না শুধু প্রতিবিম্ব দেখায় না, কিছু আয়না ভবিষ্যতের দিকে জানালাও খুলে দেয়।
আর সেই জানালায় একবার উঁকি দিলে, নিজের জীবনটাকেই নতুন করে গড়ার সুযোগ আসে।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।