শান্তা ছিল একজন রূপসী, ত্রিশের গোঁড়ায় এক একাকী গৃহবধূ। ছোট এক শহরের নিঃসঙ্গ গলি, সেখানেই তার বাড়ি। স্বামী রতন কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন, মাসে একবার বাড়ি ফিরতেন। বাড়িতে ছিল চার বছর বয়সি একটি ছেলে, আর ছিল একরাশ নিঃসঙ্গতা।
শান্তা দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাত ছেলে, রান্নাবান্না, আর সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করে। জীবনের অভ্যস্ত রুটিনে কোথাও যেন প্রাণ ছিল না। স্বামীর ভালোবাসা যেন কবে হারিয়ে গেছে দায়িত্বের ভারে।
এমন সময়ই আবির্ভাব হয় অনিকেতের।
অনিকেত, বয়স চব্বিশ, পাশের পাড়ায় থাকে। সদ্য চাকরির খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করেছে। মাঝে মাঝে মোবাইল সারানোর কাজ করে। একদিন শান্তার ফোন খারাপ হয়ে গেলে পাড়ার এক মাসির থেকে অনিকেতের নম্বর নিয়ে ডেকে পাঠায়।
সেই প্রথম দেখা।
অনিকেত যখন ফোন সারাতে শান্তার ড্রয়িংরুমে বসেছিল, তখন শান্তা প্রথমবার কোনো পুরুষের চোখে এমন সরাসরি আকর্ষণ অনুভব করেছিল। অনিকেতও অবাক হয়েছিল শান্তার রূপ, পরিপক্বতা আর চোখের গভীরতা দেখে। তাদের প্রথম আলাপেই কোথাও যেন একটি নীরব স্পন্দন ছিল।
এরপর ফোন সারানোর অজুহাতে, কখনো ছেলের জন্য ইউটিউব অ্যাপ ইনস্টল করতে, কখনো নতুন গ্যাস বিল জমা দিতে—অনিকেত প্রায়ই আসতে শুরু করে শান্তার বাড়ি।
প্রথমে অল্প কথা, পরে দীর্ঘ আড্ডা। ধীরে ধীরে সম্পর্ক এগোতে থাকে। একদিন ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ শান্তার হাত স্পর্শ করে অনিকেত। শান্তার শরীরে একরকম আলোড়ন উঠেছিল। সে হাত সরিয়ে নেয়নি।
তারপর এক সন্ধ্যায় বৃষ্টি পড়ছিল। বাইরে তখন মেঘের গর্জন। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। টিনের চালের উপর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন শান্তার বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। বিদ্যুৎ চলে গেছে ঘণ্টাখানেক আগেই। চারদিকে আধার। ছেলেটি পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরটা নিঃস্তব্ধ, শুধু জানালার ফাঁক গলে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকালে এক মুহূর্তের জন্য চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে।
শান্তা ডাইনিং টেবিলের এক কোণে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে ছিল—একটা পুরনো বই খুলে, কিন্তু চোখ তার পাতায় আটকে ছিল না। মন যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা।
“আমি, অনিকেত… পাওয়ার ব্যাঙ্কটা এনেছি,” বাইরের আওয়াজ।
শান্তা ধীরে দরজা খুলে দেয়। অনিকেত ভিজে চুলে দাঁড়িয়ে। গায়ে হালকা জ্যাকেট। তার চোখে চিরচেনা হাসি—তবে আজ যেন সেই হাসিতে লুকিয়ে ছিল এক অন্যরকম অভিপ্রায়।
ভেতরে এসে বসে অনিকেত। ঘরটা শুধু একটি মোমবাতির আলোয় আলোকিত। ছায়া পড়ে যাচ্ছে দু’জনের মুখে। অনিকেত শান্তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আলোর মধ্যে এত সুন্দর দেখাও, জানো?”
শান্তা কিছু বলে না। শুধু একবার চোখ তুলে চায়। সেই চোখে ছিল একরাশ প্রশ্ন, একফোঁটা টান, আর এক চিলতে দ্বিধা। অনিকেত সামনে এগিয়ে আসে। মোমবাতির আলো তার চোখে পড়ে—চোখ দুটোতে স্পষ্ট ঝিকিমিকি করছে।
“তুমি একা আছো আজ?” অনিকেত ফিসফিস করে।
“হ্যাঁ… ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর রতন তো…” কথাটা অসমাপ্ত রেখে দেয় শান্তা।
অনিকেত হালকা করে তার আঙুল ছুঁয়ে দেয় শান্তার হাতের পেছনে। শান্তার শরীরটা শিরশির করে ওঠে। সেই স্পর্শ যেন বহু বছর পর কোনও অনুভবকে জাগিয়ে দিল। সে হাত সরিয়ে নেয়নি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে দু’জনেই। বাইরে তখন বৃষ্টি আরও জোরে পড়ছে। একটা দূর থেকে বাজ পড়ার শব্দ হয়।
হঠাৎই অনিকেত উঠে দাঁড়িয়ে শান্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব ধীরে হাত বাড়িয়ে দেয় শান্তার গালে। “অনুমতি আছে?” তার প্রশ্ন।
শান্তার চোখে জল এসে যায়। এতদিনে কেউ তার সম্মতির গুরুত্ব বোঝে।
সে মাথা হেলিয়ে দেয়—হ্যাঁ।
তারপর, আলতো করে অনিকেত তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। সেই চুম্বন ছিল ধীর, গভীর, তৃষ্ণার্ত। সময় যেন থমকে যায় সেই মুহূর্তে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, মোমবাতির আলো নাচতে থাকে তাদের ছায়ার সঙ্গে। একে অপরকে তারা আবিষ্কার করে—শরীরের প্রতিটি স্তরে, আবেগের প্রতিটি বাঁকে।
কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না, কোনও লজ্জা ছিল না। ছিল শুধু অভাবের ভালোবাসা, আর দেহ ও মন মিলে একে অপরের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
রাত গড়িয়ে যায়। মোমবাতির আগুন নিভে আসে, কিন্তু তাদের ভেতরের আগুন তখনই জ্বলে উঠেছে।
দুজনেই জানত, এ সম্পর্ক সমাজ মেনে নেবে না। শান্তা জানত, সে একজন মা, একজন বিবাহিতা। কিন্তু অনিকেত ছিল তার জীবনে সেই উষ্ণতা, যা বহু বছর ধরে সে পায়নি।
দুজনের সম্পর্ক দিনে দিনে গভীর হতে থাকে। তারা পার্কে দেখা করত, মেসেঞ্জারে রাতভর কথা বলত, কবিতা লিখত একে অপরের জন্য। অনিকেত বলত, “তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, শান্তা।” শান্তার চোখে জল আসত, কারণ এতদিন কেউ তাকে ভালোবাসা বলে ডাকেনি।
শান্তা একদিন বলল, “চলো, আমরা পালিয়ে যাই। আমি আর এই সংসার করতে পারছি না।” অনিকেত অবাক হয়েছিল, কিন্তু রাজি হয়েছিল।
সেই এক দুপুরে, শান্তা তার চার বছরের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে, এক ব্যাগ জামাকাপড় নিয়ে অনিকেতের সঙ্গে পালিয়ে যায়। স্বামী, সংসার, সন্তান—সব পেছনে ফেলে রেখে। তার মনে হয়েছিল, এবার সে নিজের জীবনের অধিকার ফিরিয়ে নেবে।
কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক খুব বেশি ছিল।
প্রথম কদিন খুব রোমান্স, ঘোর। কিন্তু ধীরে ধীরে অনিকেতের ব্যবহার বদলাতে থাকে। সে শান্তার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে। চাকরি নেই, টাকাও শেষ। অনিকেত অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
একদিন শান্তা জেনে যায়, অনিকেত আর তাকে ভালোবাসে না। সে কেবল ভালোবেসেছিল তার শরীরটাকে, এক ঘোরে ছিল। ঝড়ের মতো সেই সম্পর্কের শেষটা এসেছিল খুব হঠাৎ। একদিন সকালবেলা অনিকেত দরজা খুলে শান্তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তোমার জায়গা এখন এখানে নেই। নতুন জীবন শুরু করতে চাই, একা।”
কথাটা শোনামাত্র শান্তার বুকটা যেন ফেটে গেল। এক মুহূর্তে সে বুঝে গেল—যাকে বিশ্বাস করে সবকিছু ছেড়েছিল, সে ছিল শুধু এক মুহূর্তের মোহ। মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দটা তার কানে ধাক্কা দিয়ে ফিরে আসছিল বারবার।
ভেজা চোখে, কাঁপা পায়ে, একা এক মেয়ের ফিরে আসা—এই শহরের লোকচক্ষুর সামনে যেন এক নিঃশব্দ পরাজয়।
শান্তা ফিরে আসে সেই পুরনো ঠিকানায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ থমকে থাকে। ছোট্ট ছেলে খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল—মা ফিরে এসেছে!
ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্তার পা। “মা, তুমি কোথায় ছিলে? আমি তোমায় খুঁজছিলাম…”
এই ছোট্ট কণ্ঠের তীব্র আবেগে শান্তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ে। সে হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে—মুখ গুঁজে কাঁদে।
কিন্তু তখনই ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে রতন। চোখে বিস্ময় নেই, বরং কঠিন এক শীতলতা। একটিবারের জন্যও শান্তার দিকে এগিয়ে আসেনি।
“রতন…” শান্তা ধীরে ধীরে বলে ওঠে। “আমি ভুল করেছিলাম। আমি… আমি বুঝতে পারিনি। প্লিজ, একটা সুযোগ দাও। আমি সব ফেলে এসেছি… আমি তোদের ছাড়া থাকতে পারব না।”
রতনের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। চোখে একটা গাঢ় ক্লান্তি। “তুমি আমাদের ফেলে চলে যাওয়ার আগে একটিবারও ভাবোনি,” সে বলে।
শান্তা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ভুল ছিল… এক মুহূর্তের দুর্বলতা… অনিকেত… ও আমাকে ঠকিয়েছে… আমি বুঝতে পেরেছি…”
রতন এক পা পিছিয়ে আসে। কণ্ঠে যেন রাগ নেই, শুধু বিষণ্ণতা। “চোখের জল অনেক দামি জিনিস, শান্তা। যাদের জন্য ফেলা হয়, তারা যদি তার মর্যাদা না বোঝে… তাহলে সেই কান্না বৃথা যায়।”
শান্তা পা ধরে বসে পড়ে, “একবার… শুধু একবার, আমার কথা শোনো…”
রতন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “মরে গেলেও তোমার সঙ্গে আর সংসার করব না। তুমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছো। এখন তার ফলও নিজেকেই ভোগ করতে হবে।”
তারপর ঘরের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। শুধু শান্তা, নিঃশব্দে কাঁদে দরজার ধারে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তার ছোট ছেলে—যার চোখেও জল।
সেই রাতে শান্তা আর ঘরে ঢোকেনি। সে জানত, তার আগের ঘর, আগের জীবন, আগের ভালোবাসা—সবই ভেঙে গিয়েছে। কেবল একটি জায়গা আছে, যেখানে সে প্রতিদিন ফিরে ফিরে কাঁদবে—তার নিজের শূন্যতার ছায়ায়।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।