রনি ছিল কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। শান্ত-শিষ্ট, নিয়মপ্রেমী, আর সবার থেকে একটু আলাদা। সে হেলমেট ছাড়া বাইক চালাত না, সিগন্যাল ব্রেক করা তো দূরের কথা — রাস্তার কুকুর পার হচ্ছে দেখলেও সে ব্রেক কষত! বন্ধুরা বলত — “রনির শরীরে আইনমন্ত্রী ঢুকেছে!”
একদিন কলেজে হঠাৎ তার প্রিয় শিক্ষক শংকর স্যার বুকে ব্যথা অনুভব করেন। অবস্থা খারাপ দেখে রনি কোনো চিন্তা না করেই তাঁকে বাইকে বসিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্যারকে নিয়ে যেতে গিয়েই সে প্রথমবার একটা বড় সিগন্যাল ভেঙে দেয়। রাস্তায় তখন কেউ ছিল না, কিন্তু রনি জানে — এই কাজটা ঠিক হয়নি।
হাসপাতালে স্যারকে ভর্তি করার পর রনির মাথায় শুরু হয় দুশ্চিন্তা। “সিগন্যাল ভাঙলাম! ক্যামেরা থাকলে ছবি তো তুলেই ফেলেছে… বাইক তো পুলিশ নিয়ে যাবে… লাইসেন্সও বাতিল করে দেবে!”।
বন্ধুরা আগুনে আরও ঘি ঢালে
— “শুনেছি ভাই, এখন অটোমেটিক ফাইন আসে!”
— “দেখিস, বাইক তো যাবেই, সঙ্গে এক মাসের হাজতবাস!”
রনি আর বাইক চালায় না। তার প্রিয় বাইকটা, যার জন্য সে নিজের পকেটমানি জমিয়ে ২ বছর অপেক্ষা করেছিল, সেটা এখন ছাদে চাদর দিয়ে ঢাকা। নিজেই সিগন্যাল ভাঙার পাপবোধে সে এখন একেবারে বাস, রিকশা আর অটোভুক্ত সাধারণ নাগরিক!
এরপর একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে রনির দেখা হয় একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে, চোখে সানগ্লাস, হাতে বই, কানে হালকা দুল। রনির পাশে এসে অটোয় বসে মেয়েটি হেসে বলে, “এই রুটে অটো খুব কম চলে, তাই পাশে বসতেই হলো!” রনি একটু লাজুক ভাবে মাথা নেড়ে নেয়।
কথা শুরু হয়। মেয়েটি জানায়, তার নাম সুহানা। এক প্রাইভেট অফিসে কাজ করে। কথার ছলে ছলে জানা গেল, বাইকে চড়ার তার খুব শখ, কিন্তু নিজের বাইক নেই।
রনি হেসে বলে, “আমার একটা বাইক আছে, খুব প্রিয়। কিন্তু এখন চালাই না…”
— “কেন? খারাপ হয়ে গেছে?”
— “না… আসলে… এটা একটু জটিল ব্যাপার।”
সুহানা চোখ ছোট করে বলে, “তুমি কি কোনো বাইক চোর? নাকি স্টান্টম্যান?”
রনি চমকে ওঠে, “না না! আমি সিগন্যাল ভেঙেছিলাম একদিন… তারপর থেকেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছি।”
সুহানা জিজ্ঞেস করে, “সিগন্যাল কেন ভেঙেছিলে, তুমি কি রাফ ড্রাইভ করো ?? ”
রনি বলে,“না না। আমি সবসময় নিয়ম মেনে চলি, কিন্তু সেদিন … ” পুরো ঘটনাটা রনি খুলে বলে। সুহানা শোনে, কিন্তু আর কিছু বলে না।
পরের ক’দিনে তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রনি প্রায়ই সুহানার অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দেয় অটোতে। এইভাবে কিছুদিন পর একদিন সুহানার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে, সে সরাসরি বলে, “শোনো, অনেক হয়েছে… এবার আমি তোমার বাইকে উঠতে চাই। একবার শুধু!”
রনি দ্বিধায় পড়ে যায়। বাইক তো দোতলায়, বৃষ্টিতে ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখা… তার মধ্যে সিগন্যাল মামলার আতঙ্ক!
তবু… মেয়েটার আবদার ফেলা যায় না। সে রাতেরবেলা বাইক পরিষ্কার করে, হালকা পলিশ করে, এবং পরদিন সুহানাকে নিতে যায়।
বাইক রাস্তায় ওঠে, রনি হালকা নার্ভাস। সুহানা হেসে বলে, “বেশ তো, তুমি তো ভালোই চালাচ্ছো!”
তারপরে এক জায়গায় বাইক থামতেই, সুহানা বাইক থেকে নামে, তার ব্যাগ থেকে বের করে ট্রাফিক পুলিশের টুপি আর ওয়াকিটকি। রনি চোখ কপালে তুলে বলে, “এটা কী?!”
সুহানা বলে, “হ্যাঁ রনি, আমি ট্রাফিক কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টে আছি। তুমি যেদিন সিগন্যাল ভেঙেছিলে, সেই রাস্তায় আমি ডিউটিতে ছিলাম। আমার চাকরির প্রথম দিন। মনে মনে তখনই আমি ঠিক করি – তোমাকে আমি ধরবোই। প্রথম দিন ডিউটিতে এসে আমি কোনো অপরাধীকে সহজে ছাড়বো না। আমি চাইলে সরাসরি তোমাকে ধরতে পারতাম। কিন্তু সিগন্যাল ভাঙার কোনো ভিডিও আমাদের কাছে ছিল না। আমি শুধু তোমার গাড়ির নম্বরটা নোট করেছিলাম। আমার কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। তাই আমি তোমার থেকে কনফেশন নেওয়ার জন্যেই এই অভিনয়টা শুরু করি। এবার আমি তোমাকে ফাইন করতে পারবো। ”
রনির মুখ রঙ পাল্টে গেছে। সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বলে, “আমি তো গেলাম! বাইকটাও গেল।”
সুহানা হেসে ফেলে, “তবে তোমার সঙ্গে মিশে জানলাম তুমি অন্য বাইকারদের মত নও। নিজের অপরাধবোধে তুমি নিজেই জর্জরিত। তাছাড়া সেদিন তুমি একজন মানুষের জীবনের জন্য সিগন্যাল ব্রেক করেছিলে। তাই সব জানার পর তখনই আমি তোমায় মনে মনে মাপ করে দিই। কিন্তু তুমি এত সিরিয়াস ছিলে যে মনে হল আরও একটু টুইস্ট দেওয়া দরকার।”
রনি বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বাইকটা কি তুমি এখন থানায় নিয়ে যাবে ??”
সুহানা চোখ টিপে বলে, “যাব, তবে থানায় না। চলো, এবার আমরা একটা সত্যিকারের রাইডে যাই। এবার কিন্তু কোনো সিগন্যাল ভেঙো না যেন।”
রনি হেসে ওঠে। বাইকের ইঞ্জিন স্টার্ট হয়। সিগন্যাল জ্বলে ওঠে সবুজ। আর তাদের গল্প এগিয়ে চলে নতুন রাস্তায়, নিয়ম মেনেই।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।