রোদ ঝলমলে এক দুপুরে, কলেজের চাকরি শেষ করে আর্য যাযাবরের মতো হাঁটছিল উত্তর কলকাতার পুরনো বইয়ের দোকানপথে। তার বয়স ছাব্বিশ, সদ্যই এক প্রাইভেট সংস্থায় চাকরি পেয়েছে। কিন্তু তার ভালোবাসা পুরনো বই, ধূলিধূসরিত পাতায় চাপা পড়ে থাকা অতীতের ঘ্রাণ। হঠাৎ এক দোকানে নজর পড়ে একটা পাতলা চামড়ার বাঁধাই ডায়েরিতে। দোকানদার বলে, “ফেলে দেওয়া পুরনো কাগজের স্তুপে ছিল, নাও যদি নিতে চাও।”
আর্যর মনে কৌতূহল জাগে। ডায়েরির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, কালি কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু লেখা স্পষ্ট। প্রথম পাতায় লেখা –
“তাকে আমি প্রতিদিন দেখি, কিন্তু বলতে পারি না কিছু। ওর নাম অর্ণব। হয়তো কোনোদিন আমার লেখা পড়বে না। তবুও লিখে যাই, নিজের ভালোলাগা বাঁচিয়ে রাখার জন্য।”
আর্য কেঁপে ওঠে। প্রতিটি পাতায় যেন এক তরুণী হৃদয়ের সমস্ত না বলা ভালোবাসা মিশে আছে। এক তরুণীর নির্ভেজাল, একতরফা প্রেমের জার্নাল – তার দুঃখ, তার আশা, তার নিঃশব্দ কান্না, তার অপেক্ষা।
শেষের দিকে একটি পাতায় লেখা—
“আজ অর্ণব বলেছিল সে পাহাড়ে যাচ্ছে ঘুরতে, আমি মনে মনে কেবল বলেছিলাম সাবধানে থেকো। কিন্তু ফিরে এল না সে… দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তাকে। অথচ আমার মনের কথা বলা হয়নি, কোনোদিন হবে না।”
আর্যর বুকের মধ্যে কী যেন ধাক্কা লাগে। নাম তার ‘অর্ণব’ নয়, তবুও কেন যেন মনে হচ্ছিল এই মেয়েটির কষ্টে নিজের একটা দায় আছে।
ডায়েরির এক কোণায় ছোট করে লেখা –
“সুরতরঙ্গ কোচিং – বাগবাজার শাখা”
সেই নামটা খেয়াল করে সে সোজা গিয়ে খোঁজ করে সেই কোচিং সেন্টার। সেখানে একজন পুরোনো স্টাফ বলে, “ও মেয়েটির নাম ছিল মায়া। এখন আর পড়াতে আসে না, কিন্তু কাছেই একটি গানের স্কুলে শেখায়।” সেই সূত্র ধরেই আর্য খুঁজে পায় মেয়েটিকে।
মায়া—একুশ বছরের শান্ত, মৃদুভাষিণী, চোখে যেন এক অভিমানী বিষাদের ছায়া। ছোট ছোট বাচ্চাদের গান শেখায়। হাসলেও তার মুখে অদ্ভুত একটা চুপচাপ ছায়া থেকে যায়।
আর্য ভাবল সরাসরি কিছু বলা ঠিক হবে না। সে অপেক্ষা করতে চায়। ধীরে ধীরে জানতে চায়, বুঝতে চায় তাকে।
সে একদিন গানের বই খোঁজার অজুহাতে মায়ার স্কুলে আসে। বলে—
— “আপনার ছাত্রদের জন্য কিছু বই খুঁজছিলাম, জানলাম আপনি সাহায্য করতে পারবেন।”
মায়া প্রথমে অবাক হয়, পরে বিনয়ের সঙ্গে বইয়ের নাম বলে দেয়। এরপর আর্য প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে আসে। কখনো কফি শপে দেখা হয়, কখনো গানের দোকানে।
এরপর শুরু হয় বন্ধুত্ব। আর্য ডায়েরির পাতাগুলোর মধ্যে থেকে মায়ার প্রিয় রং, গান, কবিতা, তার হারিয়ে যাওয়া হাসির ছায়া সব জেনে নেয়। আর তা কাজে লাগিয়ে একের পর এক এমন মুহূর্ত তৈরি করে, যেখানে মায়া ধীরে ধীরে আর্যর সাহচর্যে হাঁসতে শেখে।
একদিন হঠাৎ মায়া বলে,
— “তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে ভালো লাগে। জানো, অনেকদিন পর মনে হচ্ছে কেউ আমাকে না জেনে ভালোবাসছে।”
আর্যর গলা ভারী হয়ে আসে।
সে আর দেরি করে না। এক সন্ধ্যায় মায়াকে নিয়ে যায় সেই পুরনো বইয়ের দোকানে। সেই দোকানেই যেখানে সে প্রথম ডায়েরিটা পেয়েছিল। তারপর একটি বেঞ্চে বসিয়ে বলে—
— “তোমার একটা পুরনো বন্ধু ছিল, যার নাম ছিল অর্ণব। তুমি তাকে ভালোবাসতে, সে জানত না। আমি সেই অর্ণব নই… কিন্তু তোমার লেখা পড়ে, তোমার নিঃশব্দ ভালোবাসায় আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম তুমি দুঃখে আছো। তাই ঠিক করেছিলাম তোমার মুখে হাসি ফোটাবো। যদি কোনো ভুল করে থাকি, ক্ষমা করো। কিন্তু আমি সত্যিই তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।”
মায়া থমকে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে—
— “তুমি জানো, ডায়েরিটা হারিয়ে গিয়েছিল, অনেক খুঁজেও পাইনি। তখন ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা যেমন একতরফা ছিল, সেই লেখা গুলোও হারিয়ে যাবে। কিন্তু এখন বুঝছি—সে হারিয়ে যায়নি, রূপান্তরিত হয়েছে।
তোমার চোখে আমি আজ অর্ণবকে দেখি না, দেখি একজন নতুন মানুষ—যে আমাকে বুঝতে চায়, ভালোবাসতে চায়। আমি আজ সেই মানুষটাকেই ভালোবাসি।”
আর্যর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে মায়ার হাত ধরে বলে,
— “এইবার শুধু ডায়েরির পাতায় নয়, আমাদের জীবনের পাতায় একসাথে লিখবো ভালোবাসার গল্প।”
সেদিন বিকেলটা তাদের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ছিল।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।