পিউর বয়স মাত্র দশ। ঠিক সেই বয়সটা, যখন ভয় আর কৌতূহল একে অপরের হাতে হাত রেখে চলে। সে কখনও ভূতে বিশ্বাস করে, আবার মনের মধ্যে প্রশ্নও ঘুরে বেড়ায়—“ভূত সত্যিই আছে?”
সেই বছরের জন্মদিনে পিউর দাদা কলকাতা থেকে এসে তাকে একটা পুরনো সঙ্গীত বক্স উপহার দেয়। লাল রঙের গোল কাঠের বাক্স, ঢাকনা খুললেই একটা ছোট্ট মেয়ে ঘোরে আর ধীরে ধীরে বাজে এক মনকেমনা সুর—পুরনো দিনের গান।
দাদা বলেছিল, “এই বক্সটা এক পুরনো সংগ্রাহকের দোকান থেকে এনেছি। খুব যত্নে রেখো, এটা জাদুময়।”
প্রথম কয়েকদিন পিউ খুশি ছিল। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে বক্সটা খুলে গান শুনত, আর ঘূর্ণায়মান ছোট্ট পুতুলটার দিকে তাকিয়ে থাকত এক মনে। কিন্তু তারপর থেকেই শুরু হয় অদ্ভুত কিছু ঘটনা।
সন্ধ্যা হলেই বক্সটা নিজে থেকেই বাজতে শুরু করে। পিউ তো কখনও সেটাকে ছোঁয় না, তবুও সে ঘরে ঢুকতেই সুর ভেসে আসে—একই গান, এক মায়াময় সুর।
প্রথমে ভেবেছিল ভুল দেখছে। মা-বাবাকেও বলেছিল, কিন্তু ওরা বলেছিল, “ওসব পুরনো যন্ত্র, মাঝে মাঝে নিজে থেকেই চালু হয়ে যেতে পারে।”
কিন্তু এরপর যা হতে শুরু করল, তা আর স্বাভাবিক ছিল না।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ পিউর চোখ পড়ে ঘরের এক কোণায়। জানালার পাশে একটা ছোট ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে—একটি শিশুর মতো, তারই বয়সী, কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছায়াটা দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে আছে পিউর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
পিউ দৌড়ে মা’র কাছে গিয়ে বলল, “মা! ওখানে একটা ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল!”
মা হেসে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই চোখের ভুল দেখেছো। আয়, খাবার খেয়ে নাও।”
কিন্তু এর পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্সের সুর বাজতে শুরু করল, আর সেই ছায়ামূর্তিটা জানালার পাশে, দরজার কোণে বা আয়নার সামনে দেখা দিত। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে থাকত।
ভয়ে পিউ প্রথমে কেঁদে ফেলত। দরজা বন্ধ করে রাখত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই ছায়াটি কোনো ক্ষতি করত না, শুধু তাকিয়ে থাকত।
এক রাতে পিউ সাহস করে বলে ফেলে, “তুমি কে?”
কোনো শব্দ না হলেও, বক্সটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন পিউ খেয়াল করে, সঙ্গীত বক্সের নিচে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো আটকে আছে। সেটা টেনে বের করে দেখে লেখা—
“আমি একা, তুমি আমার বন্ধু হতে পারো?”
এইবার পিউর ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে একটা নতুন অনুভব জন্ম নেয়—সহানুভূতি।
সে কাগজের পেছনে লিখে দেয়, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?”
তারপর সেটি আবার বক্সের নিচে রেখে দেয়।
পরদিন সে আরও একটি উত্তর পায়—
“আমি সুমি। অনেক বছর আগে এই বাড়িতে থাকতাম। দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলাম। এখন এই বক্সেই বাস করি।”
সুমি? পিউ তখন তার দাদার কাছে যায়। দাদা কিছুটা থেমে থেকে বলে, “এই বাড়িটার একটা ইতিহাস আছে। আগে এখানে এক দম্পতি থাকতেন, যাঁদের একমাত্র মেয়ে—সুমি—সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। তখন ওর বয়স ছিল তোমার মতোই। তারপর থেকে কেউ এখানে থাকতে চাইত না। বক্সটা হয়তো সেই সময় থেকেই এখানে রয়ে গেছে।”
পিউ আর ভয় পায় না। বরং প্রতিদিন সে সুমির সঙ্গে কথা বলে। কাগজে প্রশ্ন লিখে দেয়, আর উত্তরে মেলে আরও অনেক গল্প। সুমি জানায়, সে আর কেউ নয়—এক পোষা ভূত, যে তার সঙ্গে থাকতে চায়, খেলতে চায়, একাকিত্ব কাটাতে চায়।
একদিন পিউ জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি মুক্তি চাও?”
সুমি উত্তর দেয়—
“না, আমি থাকতে চাই। শুধু কেউ যেন আমায় ভুলে না যায়।”
তারপর থেকে পিউ রোজ বক্সটা চালায়, সুমির সঙ্গে কথা বলে, এমনকি মাঝে মাঝে খেলাও করে একা একা—যদিও বাইরে থেকে দেখলে কেউ ভাববে পিউ একা খেলছে।
তবে পিউ জানে, সে একা নয়।
কিছু ভালোবাসা পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়।
আর কিছু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দু’পারের মাঝে—এক জীবন্তের, এক অতৃপ্ত আত্মার।
সেই বন্ধুত্ব হয়তো অদ্ভুত, কিন্তু তাতে থাকে ভালোবাসা, স্মৃতি আর এক গভীর নিরবতার বন্ধন।
সুমি এখন আর শুধু একটি ছায়া নয়, সে পিউর একান্ত পোষা ভূত।
এই গল্পটি কেমন লাগলো সেটা কমেন্টে লিখে জানান। আমাদের ভালো লাগবে। আপনার একটা ছোট্ট কমেন্ট, আমাদের লেখার উৎসাহ ।